থানকুনি পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা

থানকুনি পাতার পরিচিতিঃ

বাংলা নাম থানকুনি। অঞ্চলভেদে এটি টেয়া, মানকি, তিতুরা, থানকুনি,নামে পরিচিত। থানকুনি পাতার ইংরেজি নাম Indian Pennywort, থানকুনি আমাদের অতিপরিচিত পাতা। পুকুরপাড় বা জলাশয়ে হামেশাই দেখা মেলে। থানকুনি পাতা মিয়মিত খেতে পারলে, পেটের অসুখে কোনও দিনও ভুগতে হবে না। শরীর-স্বাস্থ্য তো সতেজ থাকেই, ছোট থেকে খাওয়াতে পারলে বুদ্ধিরও বিকাশ হয়।

এই প্রাকৃতিক উপাদানটিকে যেখানে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মাথায় করে রেখেছে। এই গাছটি ক্ষুদ্র লতা জাতীয় উদ্ভিদ। এর পাতা ক্ষুদ্র গোলাকৃতির। পাতার ধারে খাঁজ রয়েছে। বাংলাদেশের সর্বত্র এই গাছটিকে দেখতে পাওয়া যায়। তবে উপকূলীয় লবনাক্ত আবহাওয়ায় এটি ভালো জন্মে।

গ্রামীণ সাধারণ মানুষের কাছে এটি খুবই জনপ্রিয়। আর্দ্র জমিতে রোপন করলেই থানকুনি জন্মে। খুবই উপযোগী হলেও নার্সারীতেও এ লতার চারা পাওয়া কঠিন। তবে গ্রামাঞ্চলে এটি সর্বত্রই পাওয়া যায়।

থানকুনি পাতা

থানকুনি পাতার দারুন সব উপকারিতাঃ

থানকুনি এটি বাড়ির আনাচে-কানাচে, রাস্তার পাশে, পুকুর পাড়ে, মাঠে স্যাতস্যাতে জায়গাগুলোতে বর্ষাকালে বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া সারা বছরই কম-বেশি পাওয়া যায়। এই গাছ পাওয়া যায় ভারত, সিংহল, উত্তর অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি, এবং এশিয়ার অন্যান্য প্রান্তে ভেষজ ওষুধ হিসাবে এর বহুল ব্যবহার আছে। এর বহুল ব্যবহার আছে আয়ুর্বেদিক, প্রাচীন আফ্রিকীয়, চৈনিক ইত্যাদি অনেক দেশের দেশী চিকিৎসাবিদ্যায়।

আয়ুর্বেদিকশাস্ত্র মতে, থানকুনি মানব শরীরের নানা রোগ নিরাময়ের মহৌষধ। যেমনঃ-

১। এতে আছে প্রচুর ভিটামিন সি তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

২। মুখের ব্রণ দুর করে।

গলা ব্যাথার জন্য উপকারি।

৩। আমাশয়ে ভাল কাজ করে।

৪। মুখে ঘা ও অন্যান্য ক্ষতে উপকারী।

৫। সর্দির জন্য উপকারী।

৬। সাময়িকভাবে কাশি কমাতে থানকুনি সাহায্য করে।

৭। পেটের অসুখে থানকুনির ব্যবহার আছে।

থানকুনি পাতার ব্যবহার্য অংশঃ

মূল, কান্ড, ও পাতা।

থানকুনিতে যে উপাদানের উপস্থিতি রয়েছে সে গুলা হলোঃ

1. Indocentelloside

2. Brahmoside

3. Brahminoside

4. Asiaticoside

5. Thankuniside

6. Isothankuniside

7. Triterpene glycosides

8. Indocentoic  brahmic

9. Mesoinositol

10. Centellose

11. Kaempferol

থানকুনি পাতার উপকারিতাঃ

নিচে থানকুনি পাতার উপকারিতা গুলো দেওয়া হলোঃ-

জ্বর নিবারণে থানকুনি পাতাঃ

থানকুনি পাতার রস ১ চামচ ও শিউলি পাতার রস ১ চামচ মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে খেলে জ্বর ভালো হয়ে যায়।

পেটের পীড়ায় থানকুনি পাতাঃ

সামান্য পরিমাণ আমগাছের ছাল, আনারসের কচি পাতা ১টি, কাঁচা হলুদের রস, ৪/৫ টি থানকুনি গাছ শিকড়সহ ভাল করে ধুয়ে একত্রে বেটে রস বের করে খালি পেটে খেলে পেটের পীড়া ভালো হয়। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি কার্যকর।

গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় থানকুনি পাতাঃ

দুধের সাথে থানকুনি পাতার রস একত্রে মিশিয়ে প্রতিদিন সকালে ১ সপ্তাহ খেলে গ্যাস্ট্রিক ভাল হয়।

হজম শক্তি বৃদ্ধিতে থানকুনি পাতাঃ

বেগুন/পেঁপের সাথে থানকুনি পাতা মিশিয়ে শুকতা রান্না করে প্রতিদিন ১ মাস খেলে হজম শক্তি বৃদ্ধি পায়। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে থানকুনি পাতায় উপস্থিত একাধিক উপকারি উপাদান হজমে সহায়ক অ্যাসিডের ক্ষরণ যাতে টিক মতো হয় সেদিকে খেয়াল রাখে। ফলে বদ-হজম এবং গ্যাস-অম্বলের মতো সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে না।

রক্ত দূষণ রোধে থানকুনিঃ

প্রতিদিন সকালে খালিপেটে ৪ চা চামচ থানকুনি পাতার রস ও ১ চা চামচ মধু/মিশিয়ে ৭ দিন খেলে রক্ত দূষণ ভাল হয়।

বাক স্ফুরনে থানকুনি পাতাঃ

যে সব বাচ্চা কথা বলতে দেরি করে অথবা অস্পষ্ট, সে ক্ষেত্রে ১ চামচ করে থানকুনি পাতার রস গরম করে ঠান্ডা হলে ২০/২৫ ফোঁটা মধু মিশিয়ে ঠান্ডা দুধের সাথে কিছুদিন খাওয়ালে অসুবিধাটা সেরে যায়।

খুসখুসে কাশিতে থানকুনি পাতাঃ

২ চামচ থানকুনির রস সামান্য চিনিসহ খেলে সঙ্গে সঙ্গে খুসখুসে কাশিতে উপকার পাওয়া যায়। ১ সপ্তাহ খেলে পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে।

আমাশয় থানকুনি পাতাঃ

প্রতিদিন সকালে কয়েকটি থানকুনি পাতা চিবিয়ে কয়েক দিন খেলে আমাশয় ভাল হয়।

পেট ব্যথা থানকুনি পাতাঃ

 থানকুনি পাতা বেটে গরম ভাতের সাথে খেলে পেট ব্যথা ভাল হয়।

রূপচর্চায় থানকুনি পাতাঃ

যদি লাবণ্যতা কমে যায় তবে ৫-৬ চা চামচ থানকুনি পাতার রস দুধ দিয়ে খেতে হবে। নিয়মিত খেলে উপকার পাবেন।

দূষিত ক্ষত এ থানকুনি পাতাঃ

মূলসহ সমগ্র গাছ নিয়ে সিদ্ধ করে সেই পানি দিয়ে দূষিত ক্ষত ধুতে হবে।

মুখে ঘা এ থানকুনি পাতাঃ

থানকুনি পাতা সিদ্ধ পানি দিয়ে গারগিল করতে হবে।

আঘাত এ থানকুনি পাতাঃ

কোথাও থেঁতলে গেলে থানকুনি গাছ বেটে অল্প গরম করে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে প্রলেপ দিলে উপকার পাবেন।

সাধারণ ক্ষত এ থানকুনি পাতাঃ

থানকুনি পাতা বেটে ঘিয়ের সঙ্গে জ্বাল দিয়ে ঠাণ্ডা করে তা ক্ষত স্থানে লাগাতে হবে।

চুল পড়া রোধে থানকুনি পাতাঃ

অপুষ্টির অভাবে, ভিটামিনের অভাবে চুল পড়লে পুষ্টিকর ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি ৫-৬ চা চামচ থানকুনি পাতার রস দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে। থানকুনি পাতা চুল পড়া আটকে দেয়। এমনকি নতুন চুল গজাতেও সাহায্য করে।

পেটের দোষে থানকুনি পাতাঃ

মল পরিষ্কারভাবে না হলে, পেটে গ্যাস হলে, কোনো কোনো সময় মাথা ধরা এসব ক্ষেত্রে ৩-৪ চা চামচ থানকুনি পাতার গরম রস ও সমপরিমাণ গরুর কাঁচা দুধ মিশিয়ে খেতে হবে। নিয়মিত খেলে উপকার পাবেন।

স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতে থানকুনি পাতাঃ

যাদের স্মৃতি শক্তি কম আধা কাপ দুধ, ২-৩ চামচ থানকুনি পাতার রস ও এক চা চামচ মধু মিশিয়ে খেতে হবে। এই পাতায় থাকে Bacoside B, যা মস্তিষ্কের কোষ গঠনে সাহায্য করে ও রক্ত চলাচল বাড়ায়। থানকুনি পাতা নিয়মিত খেলে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।

যৌবন ধরে রাখতে থানকুনি পাতাঃ

বয়স বাড়লেও, যৌবন ধরে রেখে দেয় থানকুনি পাতার রস। প্রতিদিন একগ্লাস দুধে ৫-৬ চা চামচ থানকুনি পাতার রস মিশিয়ে খেলে, চেহারায় লাবণ্য চলে আসে।

ত্বক মসৃণে থানকুনি পাতাঃ

মৃতকোষের ফলে চামড়ায় অনেক সময়ই শুষ্ক ছাল ওঠে। রুক্ষ হয়ে যায়। থানকুনি পাতার রস মৃতকোষগুলিকে পুনর্গঠন করে ত্বক মসৃণ করে দেয়।

চর্মরোগে থানকুনি পাতাঃ

শুধু পেটই নয়, আলসার, এগজিমা, হাঁপানি-সহ নানা চর্মরোগ সেরে যায় থানকুনি পাতা খেলে। ত্বকেও জেল্লা বাড়ে।

জ্বরের প্রকোপ কমাতে থানকুনি পাতাঃ

সিজন চেঞ্জের সময় যারা প্রায়শই জ্বরের ধাক্কায় কাবু হয়ে পড়েন, তাদের তো থানকুনি পাতা খাওয়া উচিত কারণ আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে যে জ্বরের সময় ১ চামচ থানকুনি এবং ১ চামচ শিউলি পাতার রস মিশিয়ে সকালে খালি পেটে খেলে অল্প সময়েই জ্বর সেরা যায়। সেই সঙ্গে শারীরিক দুর্বলতাও কমে।

থানকুনি পাতা খুজে পাবেন কোথায়?

গ্রামে অবশ্য থানকুনি গাছের অভাব নেই। সহজেই দেখা মেলে ঝোপে জঙ্গলে। শহরাঞ্চলে থানকুনির খোঁজ পাওয়া একটু কঠিনই বটে। তবে রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ কাঁচা বাজার গুলোতে একটু খোঁজ করলেই মিলবে থানকুনি পাতা। ফ্রিজেও কয়েকদিন রাখতে পারবেন থানকুনি পাতা। আর যারা গ্রামে বাস করেন তারা বাড়ির আশপাশে খোঁজ করুন, সহজেই মিলে যাবে।

থানকুনি পাতার অপকারিতাঃ

যে কোন খাবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভাল নয়। থানকুনি পাতার ক্ষেত্রে ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবেন না এতে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেকেই আছে থানকুনি পাতা খেতে পারে না। যারা পারে না তারা জোর করে কখনো খাবেন না  এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। নিচে থানকুনি পাতার অপকারিতা দেওয়া হলোঃ-

১। প্রয়োজনের অতিরিক্ত থানকুনি পাতা খেলে পেটের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।

২। গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মায়েদের ক্ষেত্রে থানকুনি পাতা ত্বকে প্রয়োগ করা গেলেও খাওয়ার বিষয়ে গবেষকরা সতর্ক করেছেন। এই বিষয়ে খুব ক্ষতিকর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার সন্ধান না পাওয়া গেলেও এ অবস্থায় থানকুনি কে নিরাপদ বলেন না কোনো গবেষকই।

৩। প্রয়োজনের তুলনায় অত্যাধিক থানকুনি পাতা খাওয়ার ফলে আপনার মাথা ঘুরার মতো নানা ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

৪। যারা ঘুমের ঔষধ খান তারা থানকুনি খাবেন না।

৬। লিভার সমস্যায় থানকুনি পাতা খাওয়া যাবে না।

৭। সার্জারি রোগীর থানকুনি পাতা খাওয়া উচিত হবে না।

থানকুনি পাতা খাওয়ার নিয়ম

থানকুনি পাতা খাওয়ার বিশেষ কোনো নিয়ম নেই। তবে আপনারা রোগের কারণ বিশ্লেষণ করে থানকুনি পাতা বিভিন্ন উপায়ে খেতে পারেন। যেমনঃ থানকুনি পাতার রস, ভর্তা, বরি ইত্যাদি। এছাড়া থানকুনি পাতা সংরক্ষণ করার জন্য আপনারা থানকুনি পাতা ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে এর পাউডার তৈরি করে নিতে পারেন। 
পেটের পীড়া জনিত সমস্যায় থানকুনি পাতার রস খেতে পারেন। তবে গ্রাম অঞ্চলের মানুষ এখনও থানকুনি পাতার ভর্তা নিয়মিত খেয়ে থাকে।

থানকুনি পাতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

১। গর্ভবতীঃ এর নেতিবাচক প্রভাবগুলো আপনার সন্তানের ওপর পড়েতে পারে। কারণ শিশুদের জন্য এর প্রভাব পরীক্ষা করা হয়নি।
২। বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেনঃ বুকের দুধ পান করানোর কারণে তার প্রভাব শিশু সন্তানের উপর পড়তে পারে।
৩। হেপাটাইটিস বা অন্যান্য যকৃতের রোগ আছেঃ এই ধরণের রোগের ক্ষেত্রে প্রভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় নি। তাই যদি এই রোগ থেকে থাকে তবে বিরত থাকুন।
৪। অস্ত্রোপচার করানোর আগেঃ যদি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আপনার একটি নির্ধারিত অস্ত্রোপচার করা হবে তবে থানকুনি পাতা ব্যবহার করবেন না।
৫। ১৮ বছরের কম বয়সীঃ আপনার বয়স ১৮ এর কম হলে জটিল রোগের ক্ষেত্রে থানকুনি পাতার ব্যবহার করা উচিত নয়।
৬। ত্বকের ক্যান্সারের ইতিহাস আছেঃ পূর্বে যদি ত্বকের ক্যান্সার হয়ে থাকে তবে থানকুনি পাতার ক্রিম ব্যবহারে থেকে বিরত থাকুন। কারণ আপনার ত্বক তা সহ্য করতে পারবে না।

যৌবন ধরে রাখতে থানকুনি পাতার উপকারিতাঃ

যৌবন ধরে রাখতে এবং যৌন ক্ষমতা বাড়াতেও থানকুনি পাতার জুরি মেলা ভার। বয়স বাড়লেও, যৌবন ধরে রেখে দেয় থানকুনি পাতার রস। প্রতিদিন সকালে একগ্লাস দুধে ৫ থেকে ৬ চামচ থানকুনি পাতার রস মিশিয়ে খান। মাত্র সাত দিনেই ফিরে আসবে যৌবন। থানকুনি পাতার রস দুধের সাথে মিশিয়ে খেলে, চেহারায় লাবণ্য চলে আসে ও আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায়।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url