ভিটামিন এ এর উৎস, অভাবজনিত রোগ ও প্রতিকার এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

ভিটামিন এ শরীরের জন্য কেন এত প্রয়োজন?

ভিটামিন এ মানবদেহের জন্য অল্প পরিমানে প্রয়োজন হলেও এর গুরুত্ব অত্যাধিক।তাই সবসময় সুষম খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। নতুবা ভিটামিন এর অভাব জনিত সমস্যার জন্য দেহের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

ভিটামিন এ

ভিটামিন এ এর রাসায়নিক নাম কি?

ভিটামিন 'এ' র রাসায়নিক নাম 'রেটিনাল'। মানবদেহে ভিটামিন 'এ' জারিত হয়ে রেটিনোয়িক অ্যাসিড তৈরি করে।

ভিটামিন এ এর অভাব হলে কি কি সমস্যা হতে পারে?

ভিটামিন এ (রেটিনল):

ভিটামিন এ এর রাসায়নিক নাম হচ্ছে রেটিনল (যাহা প্রাণীজ খাবার থেকে পাওয়া যায়)। ১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ম্যাককুলাজ এবং ডেভিস ভিটামিন এ আবিষ্কার করেন। ১৯৩০ সালে এটি বিজ্ঞানাগারে রাসায়নিকভাবে প্রথম সংশ্লেষিত হয়। এটি চর্বিতে (ফ্যাট সলিউবল) দ্রবনীয় ভিটামিন। একজন মানুষের জন্য গড়ে প্রতিদিন 900 mcg ভিটামিনের প্রয়োজন আর শিশুদের রোজ ৩০০ থেকে ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন এ এর দরকার। গর্ভাবস্থায় ও স্তন্যদানকারী মহিলার এবং বয়:সন্ধিকালে (১৩-১৯ বছর) ভিটামিন এ এর চাহিদা বেড়ে যায়।

ভিটামিন এ এর উৎসসমূহঃ

ভিটামিন এ এর উৎসসমূহ প্রাণীজ উপাদানঃ ভিটামিন এর প্রধান উৎস হচ্ছে প্রাণীজ খাদ্য। যেমনঃ- গরু বা খাসির কলিজা, ডিমের কুসুম, মাখন, পনির, দুধ, মাছ, মাংশ ইত্যাদি। প্রাকৃতিকভাবে মাছের কলিজার তেলে সবচেয়ে বেশী পরিমানে ভিটামিন এ পাওয়া যায়। ছোট মাছ বিশেষ করে মলা মাছ ও ঢেলা মাছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন এ পাওয়া যায়।

উদ্ভিজ উপাদানঃ

উদ্ভিজ উপাদানের মধ্যেও কিছু কিছু ভিটামিন এ পাওয়া যায়। যেমনঃ- সতেজ পাতাবহুল শাক (পালংশাক, মেথিশাক, লাল শাক, ডাটা শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক, মটার শাক, লাউশাক, সজনে শাক, সরিষার শাক)বাঁধাকপি, রঙিন সবজি (গাজর, মিষ্টি কুমড়া, টমেটো) তাছাড়া বিভিন্ন ফল বিশেষ করে হলুদ রঙের বা পাকা ফলসমূহের মধ্যে ভিটামিন এ পাওয়া যায়। যেমন-আম, পাকা পেঁপে, কাঁঠাল, তরমুজ ইত্যাদি।

ভিটামিন এ এর প্রয়োজনীয়তাঃ

ভিটামিন এ (রেটিনল) এর কাজ হচ্ছে চোখ সংক্রান্ত। চেখের Photo receptor দুই প্রকারঃ রড ও কোন। রড (রড অনুজ্জ্বল আলোতে বা কম আলোতে সক্রিয় হয়, অল্প আলোতে দেখার জন্য রড অত্যাবশ্যক) ও কোন (উজ্জ্বল আলোতে সক্রিয় হয়, দিনের বেলায় কোন্ কাজ করে) এর গঠন উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে।

ভিটামিন এ এর প্রধান কাজ দেহবৃদ্ধি এবং দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো।

১। ত্বকের উৎপত্তি ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিশেষ করে শরীর কে নরম ও তুলতুলে রাখতে বেশ সহায়ক (নতুন গবেষণায় প্রমানিত। 

২। ত্বকের অত্যধিক শুষ্কতা, শ্লেষ্মা ঝিল্লীর নিঃসরণ কমে যাওয়া, হাড়, দাঁত কে সতেজ রাখতে বেশ ভাল ভুমিকা আছে।

৩। চুল আদ্র হওয়া থেকে ও ভিটামিন এ রক্ষা করে (অন্য দিকে ভিটামিন এ বেশি খেলে চুল পড়ে যায়)।

৪। চুলকানি জাতীয় অসুখ, নুখ ভেঙ্গে যাওয়া ইত্যাদি তে ভিটামিন এ খুভ ভাল সহায়ক।

৫। শিশুদের মেসেলস ও ডায়রিয়া জাতীয় অসুখ প্রতিরোধ করতে এর ভাল একটি ভুমিকা আছে।

৬। শরীরের স্কিন ক্যান্সার বা টিউমার জাতীয় অসুখে ভাল সহায়ক বিশেষ করে ব্রেস্ট ক্যান্সার ও এইডস রোগে খুবই গুরুত্ব দিয়ে এই ঔষধ উচ্চ মাত্রায় প্রয়োগ করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা।

৭। চোখের দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখতে ভিটামিন এ কাজ করে।

৮। ভিটামিন এ শিশুদের ম্যালেরিয়া, এইচআইভি, হাম এবং ডায়রিয়াজনিত জটিলতা কমিয়ে দেয়।

৯। মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিকে অতিরিক্ত রক্তপাত, মাসিকের আগে নানাবিধ উপসর্গ (Premenstrual syndrome)- যৌনাঙ্গের সংক্রমণ, ঈস্টের সংক্রমণ, স্তনের সাইক্রেসিস্টিক রোগ এবং স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।ভিটামিন এ পুরুষের শুক্রাণুর সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে।

১০। দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে, বয়সজনিত ম্যাকুলার ক্ষয়রোগ (Age related macular degeneration) এবং চোখের ছানি প্রতিরোধে ভিটামিন এ এর ভূমিকা রয়েছে।

১১। চামড়ার রোগ। যেমনঃ-ব্রন, একজিমা, সোরিয়াসিস, ক্ষত, ফোঁড়া, সূর্যফোঁড়া, ইকথারোসিস, লাইকেন প্ল্যানাস ইত্যাদি নিরাময়ে ভিটামিন এ কাজ করে।

১২। পরিপাকতন্ত্রের কিছু রোগ। যেমনঃ- আলসার, ক্রনস, মাড়ির রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন এ কাজ করে।

১৩। ডায়াবেটিস, সাইনাসের সংক্রমণ, মূত্রণালির সংক্রমণ রোধে ভিটামিন এ কাজ করে থাকে।

১৪। ভিটামিন এ সিগেলোসিস, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ, হাঁপানি, বৃক্কের পাথর, থাইরয়েডের অতিরিক্ত নিঃসরণ, লিউকোপ্লাকিয়া ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ করে।

১৫। হৃদযন্ত্র এবং রক্তসংবহনতন্ত্রের জন্য ভিটামিন এ এর ভূমিকা রয়েছে।

১৬। ভিটামিন এ বলিরেখা দূর করে এবং তাড়াতাড়ি ক্ষত শুকাতে সাহায্য করে।

১৭। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ভিটামিন এ চামড়াকে রক্ষা করে।

ভিটামিন এ এর অভাব হলে কি কি সমস্যা হতে পারেঃ

ভিটামিন এ এর অভাবজনিত চোখের সমস্যা অন্যতম। এর অভাবে চোখের যে সমস্যাগুলো হয়ে থাকে। যেমনঃ-

১। রাতকানাঃ ভিটামিন এ এর অভাবজনিত প্রথম উপসর্গ রাতকানা। এ ধরনের রোগীরা মৃদু আলোতে কম দেখে। যথা সময়ে এ রোগের চিকিৎসা না করালে চোখ অন্ধ হয়ে যেতে পারে।

২। জেরোপথেলমিয়াঃ সঠিক চিকিৎসা না হলে কনজাংটিভা এবং কর্নিয়া শুকিয়ে মোটা হয়ে যায়, একে জেরোপথেলমিয়া বলা হয়। শুষ্ক ও খসখসে চোখ এ রোগের অন্যতম লক্ষণ।

৩। বাইটটস স্পটঃ ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে কনজাংটিভায় ত্রিকোণাকৃতির সাদা ফলক (Plaque) দেখা দেয়।

৪। ক্যারাটোম্যালাসিয়াঃ ভিটামিন এ এর অভাবজনিত চোখের সর্বশেষ অবস্থা। এ ক্ষেত্রে কর্নিয়ায় আলসার হয়ে ইনফেকশন হয়ে যায় এবং রোগী চিরতরে অন্ধ হয়ে যায়।

৫। চোখের শুষ্কতাঃ বড়দের বেলায় ভিটামিন এর অভাবে চুখের দৃষ্টি শক্তির অশ্রু গ্রন্থির অকার্যকারিতা দেখা দেয় যার ফলে চোখের শুষ্কতা দেখা দেয় বেশি।

৬। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাঃ ভিটামিন এ অভাবে শরিরে ব্যাক্টিরিয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে থাকে বিধায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

৭। বার্ধক্যতাঃ নতুন ভাবে বলা হইতেছে ভিটামিন এর অভাবে যৌবনের চাকচিক্ষতা অল্প বয়সে চলে যায় বা দেখতে বয়স্ক মনে হয়। তাই রুপ চর্চায় ও ইহার গুরুত্ব আছে, অর্থাৎ বার্ধক্যতা রোধ করতে সহায়ক।

অতিরিক্ত ভিটামিন এ গ্রহণ করলে কি কি সমস্যা হতে পারেঃ

১। অতিরিক্ত ভিটামিন এ গহন করলে শারীরিক বৃদ্ধির উপর প্রভাব পড়ে, বিশেষ করে মাংশ পেশি একটু বেশি ঢিলে হয়ে যায়।

২। এছাড়া মাসিক রজঃস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া।

৩। লোহিত রক্ত কণিকা ধ্বংস হওযা, মাথা ব্যাথা এবং জন্ডিস সহ এ ধরণের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

৪। লিভার নষ্ট হওয়া, চুল ওঠা ইত্যাদি সমস্যা হয় দেখা দিতে পারে।

বিঃদ্রঃ মনে রাখবেন ভিটামিন এ যা দরকার তাই খেতে হয়। এর চাইতে অতিরিক্ত খাওয়া ঠিক নয়।

ভিটামিন এ ক্যাপসুল বেশি খেলে কি হয়?

উচ্চমাত্রার ভিটামিন এ সেবন গর্ভবতী নারীদের জন্য বিপজ্জনক। কেননা টক্সিক মাত্রায় ভিটামিন এ অনাগত শিশুর নানা ধরনের জন্মগত ত্রুটির কারণ হতে পারে। এ ছাড়া উচ্চমাত্রার ভিটামিন এ যকৃৎ, হাড় ও ত্বকের ক্ষতি করতে পারে। দুর্ঘটনাবশত হঠাৎ বেশি ভিটামিন এ খেয়ে ফেললে বমি, মাথাব্যথা, ত্বকের সমস্যা হতে পারে।

ভিটামিন এ জাতীয় খাবার তালিকাঃ

প্রতিটি খাবারের আইটেমের পাশের সংখ্যাটি 'রেটিনাল ইকুইভ্যালেন্ট' বা 'আর.ই' যা প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যে প্রাপ্ত ভিটামিন এ এর পরিমাণ নির্দেশ করে।

বিভিন্ন প্রকার শাকঃ

১। কালো কচু শাকঃ ২০০০

২। হেলেঞ্চা শাকঃ ১৩৬৭

৩। সজিনা পাতাঃ ১২৫৭

৪। পুঁই শাকঃ ১২৪০

৫। লাউ শাকঃ ১১৯৯

৬। ধনিয়া পাতাঃ ১১৫৩

৭। পাট শাকঃ ১১৫৩

৮। লাল শাকঃ ১০৫৫

৯। থানকুনি পাতাঃ ১০১৭

১০। ডাটা শাকঃ ১০০০

১১। পালং শাকঃ ৯২২

১২। মিষ্টি আলু শাকঃ ৮৬৩

১৩। মূলা শাকঃ ৬৬১

১৪। সরিষা শাকঃ ৪৩৭

১৫। মিষ্টি কুমড়া শাকঃ ৩৭৪

১৬। কলমি শাকঃ ৩৩০

১৭। বথুয়া শাকঃ ২৯০

১৮। বাটি শাকঃ ২৯০

১৯। পুদিনা শাকঃ ২৭০

বিভিন্ন সবজিঃ

১। মিষ্টি কুমড়াঃ ১২০০

২। গাজরঃ ১০০০

৩। মিষ্টি আলুঃ ৩০২

৪। সজিনাঃ ১২৫

বিভিন্ন প্রকার ফলঃ

১। পাকা আমঃ ১৩৮৩

২। পাকা কাঁঠালঃ ৭৮৩

৩। পাকা পেঁপেঃ ১২৫

প্রাণীজ খাবারঃ

১। খাসির কলিজাঃ ১৪,১৪০

২। মলা ও ঢেলা মাছঃ ১৯৬০ এবং ৯৩৭

৩। হাঁসের ডিমঃ ৩৬৯

৪। মুরগীর ডিমঃ ২৭০

৫। মুরগীর মাংসঃ ২৪৩

ভিটামিন এ

প্রতিদিন ভিটামিন এ গ্রহণের প্রয়োজনীয় পরিমাণঃ

১। শিশু (৬-৫৯ মাস): ৩৫০-৪০০ আর.ই।

২। গর্ভবতী মহিলাঃ ৪০০ আর.ই।

৩। প্রসূতি মাঃ ৮৫০ আর.ই।

ভিটামিন এ এর অভাবে শিশুদের কি রোগ হয়?

শিশুদের বেঁচে থাকা, তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও দৃষ্টিশক্তির জন্য ভিটামিন ‘এ’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভিটামিন ‘এ’ শিশুদের চোখের স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ও শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। উপরন্তু, ভিটামিন ‘এ’ বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে শিশুদের রাতকানা, অন্ধত্বসহ চোখের বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। শুধু তাই নয়, তাদের রক্তশূন্যতা দেখা দেওয়াসহ মৃত্যুও ঘটতে পারে।

শিশুকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল কখন খাওয়াবেন?

১. শিশু একটানা দুই সপ্তাহ ডায়রিয়ায় ভুগলে।

২. হামের পর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে।

৩. মারাত্মক অপুষ্টি দেখা দিলে প্রসূতি মা'কে ১-১৪ দিনের মধ্যে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ান।

শিশুদের ভিটামিন এ ক্যাপসুল বছরে কয়বার দিতে হয়?

বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য নীতিমালা অনুযায়ী, বছরে দুইবার ভিটামিন এ এর অভাব পূরণে সম্পূরক খাদ্য হিসাবে শিশুদের ভিটামিন 'এ' ক্যাপসুল খাওয়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url