ধাতু কাকে বলে? ধাতু কত প্রকার ও কি কি? ধাতু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

সূচনা (Introduction):

পদার্থ বলতে বুঝায়, যার ওজন আছে, কিছু স্থানজুড়ে অবস্থান করে, তাপ প্রয়োগে সম্প্রসারিত হয় আবার তাপ কমিয়ে নিলে সংকুচিত হয়, বল প্রয়োগে বাধার সৃষ্টি করে ইত্যাদি।

ধাতু

এই সকল পদার্থকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ-

১। কঠিন পদার্থ (Solid Substance)

২। তরল পদার্থ (Liquid Substance)

৩ । বায়বীয় পদার্থ (Airy Substance)

মূলত ধাতু এক ধরনের কঠিন পদার্থ। প্রতিদিন বিভিন্ন ধাতুর তৈরি জিনিস নানা ব্যবহারিক উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ সকল ধাতুর উৎপত্তিস্থল কোথায় কী উপায়ে পাওয়া যায় সে সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা অনেকেরই থাকে না। আসলে ধাতু বলতে খাটি ধাতু (Pure Metal) ও সংকর ধাতু (Alloy Metal) কে বুঝায়। আবার প্রতিটি ধাতুই আকরিক থেকে পাওয়া যায়। আকরিকসমূহ খনিতে, ভূপৃষ্ঠে অথবা ভূগর্ভে মাটির সাথে মিশে থাকে।

বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আকরিক থেকে মূল ধাতু (Aluminum), তামা (Copper), দস্তা (Zine), সীসা (Lead), স্বর্ণ (Gold), রৌপ্য (Silver), প্লাটিনাম (Platinum) ইত্যাদি খাঁটি অবস্থায় অপেক্ষাকৃত নরম (Soft) অবস্থায় থাকে। কখনওবা এই সকল মূল ধাতু কার্যক্ষেত্রে খাঁটি অবস্থায় গুণগত মান বর্ধন করতে সক্ষম হয় না। এ ক্ষেত্রে ধাতুর যান্ত্রিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য মূল ধাতুর সাথে অন্য কোনো ধাতু অথবা অধাতু মিশ্রিত করা হয়। যেমনঃ- খাঁটি লোহার সাথে কার্বন ও নিকেল, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি ধাতু মিশ্রিত করে সংকর ইস্পাত তৈরি করা হয়।

ধাতুর সাথে অধাতুর একত্রীকরণকে সংকরায়ন (Alloying) বলা হয়। সমভাবে তামার সাথে দস্তা মিশ্রিত করলে তৃতীয় যে ধাতুটি পাওয়া যায় সেটা একটি অলৌহজ সংকর ধাতু- যা কিনা পিতল (Brass) নামে বহুল পরিচিত। অতএব, এ কথা বলা যায় যে, দুই বা ততোধিক ধাতু মিশ্রিত করে সংকর ধাতু উৎপাদন করা হয়। সেই সংকর ধাতু শক্ত (Strong) দীর্ঘস্থায়ী ও বিশেষ গুণসম্পন্ন হয়।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ সকল ইস্পাতের নামকরণ করা হয় স্টেইনলেস ইস্পাত (Stainless Steel), হাইস্পিড ইস্পাত (High Speed Steel), পিতল (Brass), গানমেটাল (Gun Metal), ব্রোঞ্জ (Bronze) ইত্যাদি। সংকর ধাতুসমূহ উচ্চ যান্ত্রিক ধর্ম সম্পন্ন, উচ্চ ক্ষয়রোধী ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে।

ধাতু (Metals):

ধাতু হলো এক ধরনের কঠিন পদার্থ যাকে প্লেট (Plate), বার (Bar), শীট(Sheet) আকৃতি প্রদান করা যায় এবং আঘাতে ঝন্‌ঝন্ শব্দ সৃষ্টি করে বাজে তাকে ধাতু (Metal) বলে। ধাতুর উৎপত্তিস্থল খনি, ভূপৃষ্ঠ অথবা ভূগর্ভ যেখানে ধাতুসমূহ আকরিক হিসাবে মাটির সাথে মিশে থাকে। বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় আকরিক থেকে মূল ধাতু পাওয়া যায়।

ধাতব পদার্থের বৈশিষ্ট্য (Characteristies of metals):

(ক) ধাতু ওজনে ভারী এবং বর্ণও উজ্জ্বলতা বিশিষ্ট।আঘাতে ধাতব আওয়াজ বা শব্দ উৎপন্ন করে।

(গ) তাপ প্রয়োগে সম্প্রসারিত ও তাপ অপসারণ করলে সংকুচিত হয়।

(ঘ) তাপবিদ্যুৎ পরিবাহিতা গুণ থাকে। একাধিক মৌলিক ধাতুর মিশ্রণে তৃতীয় মিশ্র ধাতু উৎপন্ন হয়।

ধাতুর ধর্ম (Properties of metals):

ধাতুর ধর্মকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথাঃ-

(ক) প্রাকৃতিক ধর্ম (Natural Properties): বর্ণ, ওজন, অভ্যন্তরীণ গঠন ইত্যাদি।

(খ) যান্ত্রিক ধর্ম (Mechanical Properties): পীড়ন, বিকৃতি, স্থিতিস্থাপকতা, ঘাতসহতা ইত্যাদি।

(গ) গলনীয়তা (Fusibility): প্রযুক্ত তাপ, প্রয়োগে ভিন্ন ধাতু ভিন্ন মাত্রায় গলে যাওয়া।

(ঘ) চুম্বকত্ব (Magnetism): যে ধর্মে ধাতু চুম্বকে আকৃষ্ট হয়, যেমন- লৌহজ ধাতু।

(ঙ) বিদ্যুৎ ও তাপ পরিবাহী (Electrical and beat conductivity): বৈদ্যুতিক চার্জ পরিবহন যোগ্যতা।

আমাদের দৈনন্দিন কাজে ধাতু ব্যবহারের গুরুত্বঃ

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ধাতব বস্তুর ব্যবহার চলছে ব্যাপকহারে। আদিম যুগের মানুষেরাও গৃহস্থালী কাজে, পশু শিকারে ও আত্মরক্ষার কাজে ধাতব পাতের তৈরি বিভিন্ন হাতিয়ার তৈরি করতো তার প্রমাণ রয়েছে। পরবর্তীকালে কৃষি কাজেও ধাতুর ব্যবহার করত তারা। আর বর্তমানের যান্ত্রিক যুগে ধাতব পদার্থের ব্যবহার এত ব্যাপক যা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে ধাতব পদার্থের গুণগত মান বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ধরনের ধাতব পদার্থ আবিষ্কৃত হয়েছে যা কিনা মানব কল্যাণে সর্বত্র ব্যবহৃত হচ্ছে।

যেমনঃ- গৃহস্থালি কাজের বাসন-কোসন, হাঁড়ি কড়াই, আসবাবপত্র, যানবাহন, বিমান, স্টিমার, যুদ্ধের সরঞ্জাম যেমন- বোমারু বিমান, ট্যাংক, বন্দুক, বাইসাইকেল, রিকশা ইত্যাদি কাঁচামাল শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, মেশিনারিজ, ঘরবাড়ি, ইমারত তৈরির সামগ্রী ও সরঞ্জাম ইত্যাদি ঘর সাজানো জিনিসপত্র, রেফ্রিজারেটর, কম্পিউটার ইত্যাদি সকল সামগ্রীই কোনো না কোনো ধাতব পদার্থের তৈরি। তাই বর্তমান সভ্যতায় ধাতব পদার্থের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকতর হচ্ছে।

ধাতুর মৌলিক শ্রেণিবিভাগ (Fundamental Classification of Metals):

ধাতুসমূহকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ-

১। লৌহজ ধাতু (Ferrous Metal)

(ক) পিগ লোহা (Pig Iron)

(খ) ঢালাই লোহা (Cast Iron)

(গ) পেটা লোহা (Wrought Iron)

(ঘ) ইস্পাত (Steel)

২ । অলৌহজ ধাতু (Non-Ferrous Metal)

(ক) তামা (Copper)

(খ) অ্যালুমিনিয়াম (Aluminum)

(গ) জিংক (Zinc)

(ঘ) টিন (Tin)

(ঙ) লীড (Lead)

(চ) নিকেল Nickel)

(ছ) টাংস্টেন (Tungsten)

(জ) ক্রোমিয়াম (Chromium)

(ঝ) ভ্যানাডিয়াম (Vanadium)

(ঞ) কোবাল্ট (Cobalt)

(ট) মলিবডিনাম (Molybdenum)

এছাড়াও অলৌহজ ধাতু সংকর হিসাবে পাওয়া যায়। যথাঃ-

(ক) ব্রাস (Brass)

(খ) ব্রোঞ্জ (Bronze)

(গ) গান মেটাল (Gun Metal)

(ঘ) ফসফর ব্রোঞ্জ ( Phosphor Bronze)

(ঙ) ম্যাঙ্গানিজ ব্রোঞ্জ ( Manganese Bronze)

(চ) সিলিকন ব্রোঞ্জ (Silicon Bronze)

(ছ) অ্যালুমিনিয়াম ব্রোঞ্জ (Aluminum Bronze)

(জ) মনেল মেটাল Monel Metal)

(ঝ) ডেল্টা মেটাল (Delta Metal)

(ঞ) ডাউ মেটাল (Dow Metal)

(ট) ওয়াই সংকর (Y-Alloy)

(ঠ) অ্যালুমিনিয়াম সংকর (Aluminum Alloy)

লৌহজ ধাতু (Ferrous Metals):

লৌহজ ধাতু বা লোহার ইংরেজি নাম আয়রন (Iron)। এর বর্ণ সাদা এবং উজ্জ্বল, জলীয় বায়ুর সংস্পর্শে এলে মরিচা পড়ে বলে মলিন দেখায়। লোহা সরাসরি খনি থেকে পাওয়া যায় না, তবে প্রাকৃতিক ও অবিশুদ্ধ অবস্থায় মাটি, বালির সাথে লোহার আকরিক হিসাবে (ore) পাওয়া যায়। এই আকরিক থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে পিগ আয়রন উৎপাদন করা হয়।

আর এই পিগ আয়রনের সাহায্যে বিভিন্ন উপায়ে পেটা লোহা (wrought iron), ঢালাই লোহা (cast iron), নরম ইস্পাত (Mild steel), সংকর ইস্পাত (alloy steel) ইত্যাদি উৎপাদন করা হয়। সবচেয়ে বেশি লৌহজ ধাতুর ব্যবহার হয়ে থাকে নিত্যদিন। বাংলাদেশে কোন লোহার খনি এ যাবত আবিষ্কৃত হয়নি।

তবে ভারত, ব্রিটেন, সুইডেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি অনেক দেশে লোহার খনিতে লোহাকে আকরিক হিসেবে পাওয়া যায়।

(ক) পিগ লোহা (Pig iron): প্রাথমিকভাবে লোহার আকরিক সমূহকে গলন করে পিগ লোহা উৎপাদন করা হয়। প্রাথমিক স্তর বলে এই লোহা দিয়ে সরাসরি কোন কাঠামোগত কাজ করা যায় না। এই লোহাকে অবিশুদ্ধ লোহা বলে। ঢালাই লোহা (cast iron), ইস্পাত (steel) উৎপাদনে এই লোহা কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

পিগ আয়রত প্রধানত দুই প্রকার। যথাঃ-

১। হোয়াইট পিগ আয়রন White pig iron)

২। গ্রে পিগ আয়রন (Gray pig iron)

(খ) ঢালাই লোহা (Cast iron): লৌহ উৎপাদনের দ্বিতীয় স্তর হলো ঢালাই লোহা। পিগ লোহাকে কিউপোলা (Cupola) নামক চুল্লিতে পুনরায় গলন করে ছাঁচে ঠেলে ঢালাই লোহা উৎপাদিত হয়। এতে কার্বনের পরিমাণ থাকে সবচেয়ে বেশি। সব ধরনের ঢালাই কাজে ব্যবহার করা হয়।

ঢালাই লোহার দোষগুণ নিম্নরূপঃ

(ক) অতিরিক্ত শক্ত ও ভঙ্গুর।

(খ) বেঁকে যায় না।

(গ) আকস্মিক কম্পন সহ্য করতে পারে না।

(ঘ) চাপ শক্তি সহ্য করতে সক্ষম।

(ঙ) অপেক্ষাকৃত কম তাপ মাত্রায় গলে যায়। (১১৫০-১২৬০° সেঃ)

(চ) এর উপর সহজে মরিচা পড়ে না।

(ছ) হাতুড়ির আঘাতে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে যায়। ফলে ঢালাই লোহার ভিতরটা ভাঙলে স্ফটিকের মতো দানাদার দেখায়। এর মধ্যে কার্বনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৩-৫%। এছাড়া সিলিকন ০.৯৪-২.৮%, ম্যাঙ্গানিজ ০.৫%-১%, ফসফরাস ০.৩৫-১.২% এবং সালফার থাকে ০.১%।

সিলিকন কার্বন লোহাকে শক্ত করে, এই কার্বনকে গ্রাফাইটে পরিণত করে, ঢালাই লোহা নরম ও গলিত অবস্থায় বেশি তরল হয়। সিলিকন সংকোচন শক্তিকেও কমায়। সালফার কার্বনকে লোহার সাথে রাসায়নিক ভাবে যুক্ত করায় এবং ঢালাই লোহাকে শক্ত ও ভঙ্গুর করায়।

সংকোচন শক্তিকে বৃদ্ধি ও ধাতুকে শীঘ্র ঠাণ্ডা হতে সাহায্য করে। তবে সাধারণত এর পরিমণ ১% এর কম হওয়া ভালো। ম্যাঙ্গানিজ এর পরিমাণ ০.৪% এর কম থাকলে ঢালাই লোহা নির্দোষ হয়। ফসফরাস ঢালাই লোহাকে নরম ও তরল করে।

কাস্ট আয়রন বা ঢালাই লোহাকে নিম্নরূপে শ্রেণি বিভাগ করা যায়। যথাঃ-

১। হোয়াইট কাস্ট আয়রন (White cast iron)

২। গ্রে-কাস্ট আয়রন (Gray cast iron)

৩। মটল্ড কাস্ট আয়রন Mottled cast iron)

৪ । চিল্ড কাস্ট আয়রন (Chilled cast iron)

৫। মেলিয়েবল কাস্ট আয়রন (Malleable cast iron)

১। হোয়াইট কাস্ট আয়রন White cast iron): কার্বন এতে যুক্ত অবস্থায় থাকে বলে শক্ত বেশি হয় ও মেশিনিং সমস্যা হয়। সাধারণত এই শ্রেণির ঢালাই লোহা পেটা লোহা (Wrought iron), ইস্পাত (Steel) তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

২। গ্রে-কাস্ট আয়রন (Gray cast iron): কার্বন এতে যুক্ত অবস্থায় গ্রাফাইটরূপে অবস্থান করে। ঢালাই কাজে এই লোহা অতীব উপযোগী। সহজেই মেশিনিং করা চলে। এই লোহা দামে সস্তা ও যেকোনো জটিল আকৃতির ঢালাই করা চলে। মেশিনের বেড, বড়ি, খুচরা যন্ত্রাংশ, ইঞ্জিনের সিলিন্ডার, পিস্টন (Piston), পিস্টন রিং (Piston ring), ফ্লাই হুইল (Fly Wheel), পানির পাইপ ইত্যাদি তৈরি করতে এই লোহা খুবই উপযোগী।

৩। মটল্ড কাস্ট আয়রন Malleable cast iron): হোয়াইট ও গ্রে-কাষ্ট আয়রনের মধ্যবর্তী আর এক শ্রেণির ঢালাই লোহাকে মটলড্ কাস্ট আয়রন বলে। এই লোহা মেশিনিং যোগ্য ও অপেক্ষাকৃত নরম। ছোট ঢালাই করা যন্ত্রাংশ এই লোহার তৈরি।

৪। চিল্ড কাস্ট আয়রন (Chilled cast iron): কোন বিশেষ কাজে ব্যবহারের জন্য ঢালাই এর সময় ছাঁচের মধ্যে ইচ্ছা করেই ঢালাইকে দ্রুত ঠাণ্ডা করলে চিল্ড কাস্ট আয়রন হয়ে যায়। এর বৈশিষ্ট্য হলো দ্রুত ঠাণ্ডা হওয়াতে ঢালাই এর উপরিভাগ (Surface) শক্ত হয়ে যায়। ঢালাই লোহার তৈরি রেলগাড়ির চাকা, আখ মাড়াই মেশিন এই পদ্ধতিতে তৈরি।

৫। মেলিয়েবল কাস্ট আয়রন (Matteable cast iron): কম পরিমাণ সিলিকন এবং অধিক পরিমাণ কার্বন বিশিষ্ট হোয়াই কাস্ট আয়রনকে উত্তপ্ত অবস্থায় ক্রমাগত কয়েকদিন রাখার পর ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা করে এই লোহা তৈরি করা হয়।

কাস্ট আয়রন সনাক্তকরণঃ

(i) গ্রে-কাস্ট আয়রন শনাক্তকরণের প্রধান উপায় রং দেখে। এর রং ধূসর কালো বর্ণের এবং সহজেই মেশিনিং করা যায় ।

(ii) হোয়াইট কাস্ট আয়রন ও রং দেখে শনাক্ত করা যায়। এর রং রূপালী সাদা। এটি মেশিনিং করা কষ্টসাধ্য।

(iii) গ্রাইন্ডিং মেশিনে গ্রাইন্ডিং স্ফুলিঙ্গের ধরন দেখেও এটা শনাক্ত করা যায়।

(গ) পেটা লোহা (Wrought iron):

পেটা বা কাঁচা লোহাকে লোহার প্রায় বিশুদ্ধ অবস্থা বলা যেতে পারে, কেননা এতে খাদ খুবই সামান্য থাকে। এই লোহাতে শতকরা ০.১৫ ভাগ কার্বন ও অন্যান্য উপাদান থাকে ও ১-৩ ভাগ ধাতুমল থাকে। এতে অন্যান্য উপাদানসমূহ সিলিকন, ম্যাঙ্গানিজ, সালফার ও ফসফরাস ইত্যাদি থাকে। পিগ আয়রনকে পাডলিং চুল্লিতে গলিয়ে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পেটালোহা তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়া সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ বিধায় পেটা লোহার মূল্য অনেক বেশি হয়।

খুব সামান্যই পেটা লোহাকে ওয়েল্ডিং করা যায়। সোল্ডারিং ও ব্রেজিংও করা যায়। এই ধাতু নরম ও নমনীয় বিধায় পাতলা পাত, তার ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব হয়। পেটা লোহায় সহজে মরিচা ধরে না। জাহাজের নোঙ্গর, চেইন, হুক, পাইপ, পাইপ ফিটিংস, শীট, রিভেট, পেরেক, তার ও ইস্পাত তৈরির মূল ধাতু (Base metal) হিসেবে পেটা লোহার ব্যবহার অনেক বেশি।

(ঘ) ইস্পাত (Steel):

ঢালাই লোহা সব কাজের উপযোগী নয়। আবার পেটা লোহা ভঙ্গুর না হলেও খুব শক্ত লোহা নয়৷ পেটা লোহা ও ঢালাই লোহার মাঝামাঝি লোহা হলো ইস্পাত এবং এটা সর্বাপেক্ষা কার্যোপযোগী ও মজবুত। সাধারণত ঢালাই লোহার অপবস্তু দূর করে ইস্পাত তৈরি করা হয়। যে লোহাতে কার্বনের পরিমাণ শতকরা ০.১৫ হতে ১.৫ ভাগের মধ্যে থাকে তাকে ইস্পাত বলে। এতে কার্বাইড (Fe3C) রূপে কার্বন উপস্থিত থাকে। অন্যান্য উপাদানের মধ্যে কমবেশি সিলিকন, সালফার, ফসফরাস ও ম্যাঙ্গানিজ থাকে।

প্রধানত নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে ইস্পাত তৈরি করা হয়। যথাঃ-

(১) সিমেন্টশন পদ্ধতি

(২) ক্রুসিবল পদ্ধতি

(৩) ডুপ্লেক্স পদ্ধতি

(৪) বৈদ্যুতিক পদ্ধতি

৫। ওপেন হার্থ পদ্ধতি

৬। বেসিমার পদ্ধতি

৭। এলডি পদ্ধতি

ইস্পাতের শ্রেণি বিভাগ (Classification of steel):

ইস্পাত প্রধানত দুই প্রকার। যথাঃ-

(ক) প্লেইন কার্বন ইস্পাত (Plain carbon steel)

(খ) সংকর ইস্পাত (Alloy steel)

কার্বন ইস্পাত (Carbon steel):

কেবলমাত্র কার্বন ও লোহার মিশ্রণে কার্বন ইস্পাত তৈরি হয়। কার্বন ইস্পাতে সাধারণত ০.০৫-১.৫% কার্বন থাকে । কার্বন ইস্পাত তিন প্রকার। যথাঃ-

(১) মাইল্ড স্টিল বা লো কার্বন ইস্পাত (কার্বনের পরিমাণ ০.০৫-০.৩৫%)।

(২) মিডিয়াম কার্বন ইস্পাত (কার্বনের পরিমাণ ০.৩৫-০.৫%)।

(৩) হাই কার্বন ইস্পাত (কার্বনের পরিমাণ ০.৫-১.৫%)।

(৪) টুল ইস্পাত (কার্বনের পরিমান- ১.৫%)

লো-কার্বন ইস্পাতঃ

০.০৫-০.১৫% কার্বন মিশ্রিত ইস্পাতকে ডেড-মাইল্ড ইস্পাত বলে। লো-কার্বন ইস্পাতকে মাইল্ড স্টিলও বলে। সাধারণত রিভেট, স্ক্রু, প্রেস সিট, পাইপ, পেরেক, চেইন, প্লেট বা থালা এবং অটোমোবাইল বডির সিট, অটোফ্রেম, আই বীম ইত্যাদি তৈরি করতে লো-কার্বন ইস্পাত ব্যবহৃত হয়।

মাইল্ড স্টিলকে বা লো কার্বন ইস্পাতকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ

(i) ডেড মাইল্ড স্টিল (Dead mild steel): ০.১% ভাগ পর্যন্ত কার্বন।

(ii) মাইল্ড স্টিল (Mild steel): ০.২৫% ভাগ পর্যন্ত কার্বন।

(iii) স্ট্রাকচারাল স্টিল (Structural steel): ০.৩৫% পর্যন্ত কার্বন।

মিডিয়াম কার্বন ইস্পাতঃ

প্রধানত মিডিয়াম কার্বন ইস্পাত শ্যাফ্ট, এক্সেল, বোল্ট, কানেক্টিং রড, চাবি, গিয়ার, হালকা স্প্রিং, সিলিন্ডার, ক্যাম, নাট-বোল্ট, কাপলিং, ক্র্যাংক শ্যাফ্ট, পিনিয়ন, ইঞ্জিনের ভাল্ভ, স্প্রীং, টারবাইন, বাকেট হুইল, স্টিয়ারিং আর্ম প্রভৃতি তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়।

হাই কার্বন ইস্পাতঃ

অনেক কাজে হাই কার্বন ইস্পাত ব্যবহৃত হয়। ক্র্যাংক শ্যাফ্ট, ব্লেড, অটোমোবাইল স্প্রীং, এনভিল, ব্যান্ড-স, চিজেল, পাঞ্চ, শেয়ার ব্লেড, ট্যাপ, ডাই, মিলিং কাটার, লেদের কাটিং টুল, রিমার, ফাইল, কোদাল, রেইল, পিয়ানোর তার, রেঞ্চ, রেজর প্রভৃতি নানা জিনিস তৈরি হয়।

টুল স্টিল (Tool steel):

সচরাচর এটি খুবই শক্ত এবং ঘর্ষণ ও ক্ষয় প্রতিরোধী হয় বিধায় বিশেষত টুলস তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। যেমন কাটিং টুল, টুল বিট, মিলিং কাটার ইত্যাদি তৈরি করার কাজে ব্যবহৃত হয়।

এ্যালয় স্টিল (Alloy steel):

কার্বন স্টিলের সাথে এক বা একাধিক ধাতু মিশ্রিত করে তৈরি স্টিলকে এ্যালয় 'স্টিল’ বলে। কার্বন স্টিলের চেয়েও অধিক গুণসম্পন্ন স্টিলের প্রয়োজনের ক্ষেত্রে অ্যালয় স্টিল তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে যে ধাতু মিশ্রিত করে অ্যালয় স্টিল তৈরি করা হয় তার নামানুসারে অ্যালয় স্টিল নামকরণ করা হয়।

যেমন যখন কার্বন স্টিলের সাথে নিকেল মিশ্রিত করে অ্যালয় স্টিল উৎপাদন করা হয়, তখন উক্ত স্টিলকে নিকেল স্টিল বলে। এছাড়া যদি অতিরিক্ত দু'টি ধাতু যেমন নিকেল ও ক্রোমিয়াম মিশ্রত করে যে অ্যালয় স্টিলপাওয়া যায় তাকে নাইক্রোম স্টিল বা নিকেল ক্রোমিয়াম স্টিল বলে।

নিম্নে ক’টি উল্লেখযোগ্য অ্যালয় স্টিলের নাম ও তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা উল্লেখিত হলোঃ-

(ক) স্টেইনলেস স্টিল (Stainless Steel):

কার্বন স্টিলের সাথে ৪% হতে ২২% ক্রোমিয়াম এবং অল্প পরিমাণ নিকেল মিশ্রণে যে স্টিল পাওয়া যায় তাকে স্টেনলেস স্টিল (Stainless Steel) বলে। এই স্টিলের ক্ষয়রোধ শক্তি এবং মরিচা প্রতিরোধ ক্ষমতা এতই বেশি যে, দীর্ঘদিন ব্যবহারের পরেও এতে মরিচা কিংবা ক্ষয় হওয়ার কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। এজন্য এর ব্যবহারও খুব বেশি। গৃহস্থলির বাসনপত্র, চামচ, ছুরি, ঘড়ির কেস, ডাক্তারি সরঞ্জাম, রাসায়নিক সরঞ্জাম ইত্যাদি এই স্টিল দ্বারা তৈরি হয়।

(খ) টাংস্টেন স্টিল (Tumgsten steel):

এই স্টিল খুবই শক্ত এবং সহজে স্থায়ী চুম্বকে রূপান্তর লাভ করে। এছাড়া একে তারে (Wire) ও পরিণত করা যায়। টাংস্টেন স্টিল দ্বারা ইলেকট্রিক বাতির ভিতরকার ফিলামেন্ট, চুম্বক, মেশিনের কাটিং টুল ইত্যাদি তৈরি করা যায়।

(গ) নিকেল স্টিল (Nickel Steel):

নিকেল স্টিল খুবই শক্তিসম্পন্ন এবং আঘাত সহিষ্ণুতা স্টিল। এতে সাধারণত শতকরা ৫ ভাগ নিকেল এবং ০.১ ভাগ হতে ০.৪ ভাগ কার্বন বিদ্যমান থাকে। এর দ্বারা থার্মাল প্লেট, জাহাজের শ্যাফট, পিস্টন রড, কানেটিং রড, সাইকেলের ফ্রেম এবং স্পোক, ওয়্যার রোপ ইত্যাদি তৈরি করা হয়।

(ঘ) ক্রোমিয়াম স্টিল (Chromium steel):

এটি নিকেল স্টিল থেকে অধিকতর শক্তিসম্পন্ন এবং ক্ষয় প্রতিরোধী। ক্রোমিয়াম স্টিলের ঘর্ষণজনিত ক্ষয় রোধের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। ক্রোমিয়াম স্টিলের দ্বারা বলপেনের নিব, বল বিয়ারিং, ব্লেড, রোলার ইত্যাদি তৈরি করা হয়।

(ঙ) নিকেল-ক্রোমিয়াম স্টিল (Nickel-chromium steel):

একে নাইক্রোম (Nichrom) স্টিলও বলা হয়ে থাকে। এর শক্তি ও সামর্থ্য ক্রোমিয়াম স্টিল থেকে অধিকতর। বিশেষ করে অতি উচ্চ তাপ কিংবা চাপে এর গুণাগুণ অক্ষুণ্ন থাকে বিধায় উচ্চ তাপ কিংবা চাপযুক্ত ক্ষেত্রে এর ব্যবহার দেখা যায়। মোটরগাড়ি এবং অ্যারোপ্লেনের এক্সেল (axell), কানেকটিং রড (Connecting Rod), ক্র্যাংক শ্যাফ্ট, উচ্চ শ্রেণির গীয়ার ইত্যাদি তৈরিতে যথেষ্ট ব্যবহৃত হয়। এছাড়া নিকেল ক্রোমিয়াম স্টিল এর তৈরি তার (Wire) হিটারের কয়েল রূপেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

(চ) ম্যাঙ্গানিজ স্টিল (Manganese Steel):

ম্যাঙ্গানিজ স্টিল খুবই শক্ত এবং দীর্ঘস্থায়ী। এই স্টিলে শতকরা ১৫ ভাগ হতে ২২ ভাগ পর্যন্ত ম্যাঙ্গানিজ ব্যবহার করা হয়। একে চুম্বকে পরিণত করা যায় না। এর দ্বারা সাধারণত স্পিন্ডেল শ্যাফ্ট, কানেকটিং রড, সিন্দুক, পিস্টন রিং, পুশ রড ইত্যাদি তৈরি করা হয়। বিশেষ করে অধিক দুশ্চেদ্রতা গুণসম্পন্ন বিধায় কয়লা, ইট ও পাথর, ভাঙ্গার ক্রাশারের ‘জ্যা’ এবং রোলার তৈরিতে এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

(ছ) হাইস্পিড স্টিল (High speed steel):

হাইস্পিড স্টিল খুবই শক্ত এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টুল স্টিল। এতে শতকরা ১৪ ভাগ থেকে ২২ ভাগ পর্যন্ত টাংস্টেন থাকে। সাধারণ মানের হাইস্পিড স্টিলে শতকরা ১৮ ভাগ টাংস্টেন, ৪ ভাগ ক্রোমিয়াম, ১ ভাগ ভেনাডিয়াম, কার্বন এবং অবশিষ্ট ভাগ লোহা থাকে। একে ১৮-৪-১ স্টিলও বলা হয়। ধাতু কাটার জন্য যে বাটালি বা কাটিং টুল ব্যবহার করে থাকি তা হাইস্পিড স্টিল-এর হলে খুব দ্রুত এবং সহজ উপায়ে ধাতু কাটা যায়।

অন্যথায় কাটিং বিট এর মাথা ঘর্ষণজনিত তাপে সহজেই গরম হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু হাইস্পিড স্টিলের কাটিং টুল গরমে লাল হলেও কাটার ক্ষমতা নষ্ট হয় না।হাইস্পিড স্টিল-এর দ্বারা ডাক্তারি যন্ত্রপাতি, লেদ, শেপিং, মিলিং মেশিনের কাটিং টুল, ড্রিল বিট, ট্যাপ, ডাই (die) ইত্যাদি তৈরি হয়।

(জ) সিলিকন স্টিল (Silicon steel):

সিলিকন স্টিল জেনারেটর ও ট্রান্সফরমার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

(ঝ) মলিবডেনাম স্টিল (Molebdenum steel):

এই স্টিলের টানা শক্তি প্রবল। সাধারণত অটোমোবাইল পার্টস এবং বিমানের কাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

স্টিল শনাক্তকরণঃ

১। মাইল্ড স্টিলঃ এটির আবরণ মসৃণ এবং মরিচাহীন অবস্থায় নীলাভ দেখায়। মরিচা পড়লে একে লালচে বাদামি দেখায়।

২। মিডিয়াম কার্বন স্টিলঃ এটির আবরণ মসৃণ এবং মরিচাহীন অবস্থায় নীলাভ কৃষ্ণবর্ণ দেখায়, মরিচা পড়লে এটিকে লালচে বাদামি দেখায়।

৩। হাইকার্বন স্টিলঃ এটির আবরণ মসৃণ এবং মরিচাহীন অবস্থায় গাড়-নীলাভ-কৃষ্ণবর্ণ দেখায়। মরিচা পড়লে এটিকে লালচে বাদামি দেখায়।

স্ফুলিঙ্গ দৃশ্য (Spark picture):

স্ফুলিঙ্গ দৃশ্য দ্বারা লৌহ ও বিভিন্ন ইস্পাতের ধাতুর খণ্ডকে গ্রাইন্ডিং হুইলের উপর নির্গত স্ফুলিঙ্গ দৃশ্যের যে রূপ হয় তাতে কোনো ধরনের লৌহ ও ইস্পাত বুঝা যায়। গ্রাইন্ডিং চাকাতে শান বা ঘর্ষণ করার সময় ধাতুর কণাগুলো অত্যন্ত উত্তপ্ত অবস্থায় বিক্ষিপ্ত হতে থাকে। অধিক কার্বন বিশিষ্ট স্টিলের বেলায় রশ্মির সংখ্যা বেশি হয় এবং স্ফুলিঙ্গগুলি উজ্জ্বল শ্বেতবর্ণের আলোক বিস্তার কারে কার্বন যত কম হবে আলোর রশ্মি ও স্ফুলিঙ্গ, বর্ণ তত কম হবে। রশ্মির সংখ্যা অতি কম প্রায় তিন-চারটে হয়।

অলৌহজ ধাতু (Non-Ferrous metal):

নিচে অলৌহজ ধাতুর তালিকা ও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

তামা (Copper):

লোহার পরেই তামার স্থান। তামা নরম, ডাক্টাইল, নমনীয় এবং খুবই ঘাতসহ (Tough), এর তাপ ও বিদ্যুৎ পরিবাহিতা গুণ খুব বেশি। খনি থেকে প্রাকৃতিক অবস্থায় অক্সাইড (Oxide), সালফাইড (Sulphide) কার্বনেট (Corbonet) ইত্যাদি আকরিক রূপে পাওয়া যায়। শুদ্ধ অবস্থায় তামা নরম থাকে। ঠাণ্ডা অথবা উত্তপ্ত অবস্থায় ফের্জিং, রোলিং (Rolling) প্রণালিতে আকার পরিবর্তন করা, রোলিং (Rolling) প্রণালিতে শীট বা পাত তৈরি করতে এবং ড্রয়িং (Drawing) প্রণালিতে টেনে তারে পরিণত করা যায়। 

তারে ঠাণ্ডা অবস্থায় কাজ করতে গেলে তামার ভঙ্গুরতা বেড়ে যায়। এ সময় তামাকে এনিলিং করে নরম করতে হয়। তাছাড়া তামাকে উত্তপ্ত করে সাথে সাথে ঠাণ্ডা পানিতে নিমজ্জিত করলেও নরম হয়ে যায়। তামাকে ঢালাই করা চলে ও উপরিভাগ উত্তমরূপে পলিশ করা যায়। তামা প্রায় ১০৮° সেঃ তাপমাত্রায় গলে। প্রতি ঘনসেন্টিমিটার আয়তনের ওজন ৮.৮২ গ্রাম। তামা সংকর তামা অপেক্ষা অধিক গুণসম্পন্ন ও বেশি প্রয়োজনীয়।

সংকরগুলো পিতল, ব্রোঞ্জ, কাঁসা, তামা ও নিকেল সংকর ইত্যাদি। বৈদ্যুতিক তার, বয়লারের ফায়ার টিউব, স্টে (Stay) স্টিম ও পানির পাইপ, শীট, রেডিয়েটর, রেফ্রিজারেটর, কনডেনসর ইত্যাদিতে এবং টিন, জিংক ইত্যাদি মিশ্রিত করে তামা সংকর তৈরি করা হয়।

অ্যালুমিনিয়াম (Aluminum):

সাধারণ সকল মৌলিক ধাতুর মধ্যে অ্যালুমিনিয়াম সবচেয়ে হাল্কা ধাতু এবং রং উজ্জল সাদা, বক্সাইট নামক আকরিক থেকে এই ধাতু পাওয়া যায়। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এই ধাতু ও নরম ও স্থিতিস্থাপক গুণসম্পন্ন হয়। শুদ্ধ অবস্থায় অ্যালুমিনিয়াম খুব নরম থাকে। তবে বাজারে যে অ্যালুমিনিয়ামের জিনিসপত্র পাওয়া যায় তাতে শতকরা ৩.২৫ ভাগ লোহা ও ০.৫০ ভাগ সিলিকন মিশানো থাকে বলে অপেক্ষাকৃত শক্ত দেখায়। এই ধাতুকে উত্তমরূপে পলিশ করা যায়।

এর উপরিভাগ অবহাওয়া দ্বারা আক্রান্ত হয় না বলে মলিন হয় না বা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। সাধারণ তাপে নাইট্রিক এসিডের উপর কোনো ক্রিয়া করে না। কিন্তু হাইড্রক্লোরিক এসিডে শীঘ্র গলে যায়। সালফিউরিক এসিডেও গলে তবে ধীরে ধীরে। অ্যালুমিনিয়াম উত্তম তাপ ও বিদ্যুত পরিবাহী গুণ সম্পন্ন। ৬৫০° তাপমাত্রায় গলে যায় ও সহজে ঢালাই করা যায়। উত্তম প্রসারতা গুণ থাকায় ক্রমাগত আঘাতে কাগজের ন্যায় পাতলা পাতে পরিণত করা যায়।

এই পাতকে কয়েল (Coil) বলে। চা, সিগারেট, ঔষধসহ বিশেষ ধরনের মোড়ক তৈরিতে এই কয়েল ব্যবহৃত হয়। এছাড়া রোলিং ফোর্জিং প্রণালিতে আকার পরিবর্তন করে তারে পরিণত করা যায়। বৈদ্যুতিক লাইনের তার উৎপাদন করা হয় এ ধাতু দিয়ে। অ্যালুমিনিয়ামে ব্রেজিং ও সোল্ডারিং করা যায় না তবে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ওয়েল্ডিং করা চলে। এ্যালুমিনিয়াম পাউডার রঙে এর উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

এর প্রতি ঘন সেন্টিমিটার আয়তন ২.৬ গ্রাম। অন্যান্য ধাতুর সাথে মিশ্রিত করে অ্যালুমিনিয়াম সংকর হিসেবে ব্যাপক ব্যবহৃত হয়। পাত (Sheet) গৃহস্থলির বাসনপত্র, ইলেট্রিক তার, মোটর গাড়ির ইঞ্জিনের অংশবিশেষ ও বিভিন্ন ধরনের অ্যালুমিনিয়াম সংকর উৎপাদনে এই ধাতু ব্যাপক ব্যবহৃত হয়।

জিংক (Zinc):

বাংলা নাম দস্তা। দেখতে নীলাভ সাদা রং। জিঙঙ্ক ব্লেড, ক্যালামাইন ইত্যাদি দস্তার আকরিক। বাজারে যে শ্রেণির দস্তা পাওয়া যায় তাকে স্পেল্টার (Spelter) বলে। ১০০-১২০০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় দস্তা ভঙ্গুর হয় আর তখন এই দস্তাকে সহজেই চূর্ন করা যায়। সামুদ্রিক লবণ পানি, আবহাওয়ার আক্রমণ থেকে লোহাকে রক্ষা করার জন্য লৌহ সামগ্রীর উপর দস্তার প্রলেপ দেয়া হয়। এই ব্যবস্থাকে গ্যালভানাইজিং বলে।

সংক্ষেপে বলা হয় জিআই। জিআই শীটে সহজে মরিচা পড়ে না। দস্তা হাইড্রোক্লোরিক এসিডে গলে যায়। ৪১৫° সেঃ তাপমাত্রায় দস্তা গলে যায় ও প্রতি ঘনসেন্টিমিটার আয়তনের ওজন ৭.২ গ্রাম।

শীট, ঘরের ছাদের জন্য ঢেউটিনে, গ্যালভানাইজিং ম্যাটেরিয়াল হিসাবে, ব্যাটারির প্রাইমারি সেল গঠনে, রং তৈরির উপাদান হিসাবে, সোল্ডার তৈরিতে, তামা সংকর তৈরিতে ব্যপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

টিন (Tin): 

বাংলা নাম রাং। আকরিকের নাম টিন স্টোন (Tin Stone)। উজ্জ্বল এবং হরিদ্রা আভাযুক্ত সাদা রং। টিন, রৌপ্য অপেক্ষা নরম। কিন্তু সীসা (Lead) অপেক্ষা শক্ত। ক্রমাগত আঘাতে টিন ফয়েল তৈরি করা যায়। এ ফয়েল চা, সিগারেট, ঔষধ ইত্যাদির প্যাকেট অথবা আবরণ হিসেবে ব্যবহার হয়। সাধারণ অবস্থায় টিন বায়ুর অক্সিজেন দ্বারা আক্রান্ত হয় না এবং খাদ্যদ্রব্যে যে এসিড থাকে তা টিনের উপর ক্রিয়া করে না।

এ কারণে খাদ্যদ্রব্যে পাত্রের ভিতরে টিনের প্রলেপ দেয়া হয়। টিন মাত্র ২৩২০ সেঃ তাপমাত্রায় গলে এবং এর প্রতি ঘন সেন্টিমিটার আয়তনের ওজন ৭.৪ গ্রাম। রট আয়রনের উপর প্রলেপ দিয়ে টিন শীট (Sheet tin) টিন প্লেট (Tin Plate), এবং প্যাকিং-এর কাজে ব্যবহার্য টিন ফয়েল তৈরিতে টিন যথেষ্ট পরিমাণ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এছাড়া সফ্ট সোল্ডার (Solder), ব্রোঞ্জ, বেবিট মেটাল ইত্যাদি ধাতু সংকর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

লিড (Lead): 

বাংলা নাম সীসা। এর প্রলেপ আকরিকের নাম গ্যালেনা (Galena) অর্থাৎ লীড সাফাইড। এর রং নীলা আভাযুক্ত ধূসর বর্ণ এবং উজ্জ্বল। কিন্তু জলীয় বাস্পের প্রভাবে খানিকটা মলিন দেখায়। এই ধাতু নরম ও ভারী। শুদ্ধ সীসা সাধারণ অবস্থায় সালফিউরিক এসিড ও হাইড্রক্লোরিক এসিড দ্বারা আক্রান্ত হয় না, কিন্তু নাইট্রিক এসিডে সহজে গলে যায়। টানা শক্তি খুব কম বলে তারে পরিণত করা যায় না।

এর গলন তাপমাত্রা প্রায় ৩২৫° সেঃ। প্রতি ঘনসেন্টিমিটার আয়তনের ওজন প্রায় ১১.৪২ গ্রাম। সীসাকে ঢালাই করা যায়। সমুদ্রের লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত হয় না। সফ্ট সোল্ডার, ব্রোঞ্জ, বিয়ারিং মেটাল ইত্যাদি সংকর ধাতু তৈরিতে সীসা প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হয়।

সালফিউরিক এসিডের আধার, সিসটার্ন, পাইপ,ব্যাটারির প্লেট, হোয়াইট লীড, বন্দুকের গুলি, ছাপাখানার অক্ষর পিউটার, বৈদ্যুতিক তারের আবরণী, বয়লারের সেটি প্লাগ, বৈদ্যুতিক কেবলের ইনসুলেটর ইত্যাদি তৈরির উপাদান হিসেবে সীসা ব্যবহার করা হয়।

নিকেল (Nickel):

পিরোটাইট, নিকোলাইন ইত্যাদি আকরিক থেকে নিকেটন পাওয়া যায়। নিকেলের বর্ণ অতি উজ্জ্বল তথা রৌপ্যের মতো সাদা। বাতাসের অক্সিজেন দ্বারা আক্রান্ত হয় না বিধায় অনেক ধাতু দ্রব্যের উপরে নিকেলের অতি সূক্ষ্ম আবরণ অর্থাৎ প্লেটিং (Plating) দেয়া হয়ে থাকে। নিকেলকে পলিশ করা যায়।

এটা বিদ্যুৎ পরিবাহী প্রায় ১৪৫০° সেঃ তাপমাত্রায় গলে ও প্রতি ঘনসেন্টিমিটার আয়তনের ওজন প্রায় ৮.৯ গ্রাম। স্টিলের সাথে মিশ্রিত করে নিকেল স্টিল ও কপার এবং জিংক-এর সাথে মিশিয়ে জার্মান সিলভার (German Silver) ইত্যাদি মিশ্র ধাতু তৈরি হয়ে থাকে।

টাংস্টেন (Tungsten):

উলফ্রামাইট, সিলাইট ইত্যাদি আকরিক থেকে টাংস্টেন ধাতু পাওয়া যায়। এই ধাতুর নিষ্কাষণ বেশ জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ। এটা একটা দুষ্প্রাপ্য ধাতু সংকর। উচ্চ গলনাঙ্ক সম্পন্ন এই ধাতু ইস্পাতের সাথে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মিশ্রিত হয়ে ভিন্ন নামের সংকর ইস্পাত তৈরি করে।

বিশুদ্ধ টাংস্টেন প্রায় ৩৬০০° সেঃ তাপমাত্রায় গলে, আর এর প্রতি ঘন সে.মি. আয়তনের ওজন ১৯.১ গ্রাম প্রায়। উচ্চ গলনাঙ্ক গুণের জন্য বৈদ্যুতিক বাতির ফিলামেন্ট তৈরি করা হয়। এ ছাড়া টাংস্টেন ধাতুসংকর রূপে ব্যবহৃত হয়।

ক্রোমিয়াম (Chromium):

ক্রোমিয়াম ধাতু সাধারণ ক্রোমাইট নামক আকরিক থেকে বিভিন্ন নিষ্কাষণ প্রক্রিয়া প্রয়োগে পাওয়া যায়। এটা উজ্জ্বল শক্ত ধাতু। পলিশ করলে ক্রোমিয়াম অত্যন্ত উজ্জ্বল দেখায়। এটা ক্ষয়রোধী ও ঘাতসহ ধাতু। জলীয় বায়ুর প্রভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না বরং মরিচা ও ক্ষয়রোধক উপাদান হিসেবে ইলেকট্রোপ্লেটিং প্রনালিতে ক্রোমিয়ামের প্রলেপ দেয়া হয়। এর গলন তাপমাত্রা ৭.১ গ্রাম। ক্রোমিয়াম স্টিল, স্টেইনলেস স্টিল, রং ইত্যাদি উৎপাদন করতে ক্রোমিয়াম ব্যবহৃত হয়।

ভ্যানাডিয়াম (Vanadium):

প্রকৃতিতে মৌল অবস্থায় ভ্যানাডিয়াম পাওয়া যায় না। প্যাট্রোনাইট, ভ্যানাডিনাইট ইত্যাদি সীসা সহযোগে এই ধাতুর আকরিক প্রকৃতিতে অবস্থান করে। আর এই জাতীয় আকরিক থেকে ভ্যানাডিয়াম পাওয়া যায়। নিষ্কাষণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল হওয়ায় এর মূল্যমান অনেক বেশি। গলনাঙ্ক প্রায় ১৯৫৯° সেঃ ও প্রতি ঘনসেন্টিমিটার আয়তনের ওজন প্রায় ৫.৮ গ্রাম।

ভ্যানাডিয়াম তাপরোধ করার এবং শক বা কম্পন রোধ করার ক্ষমতা বাড়ায় এবং শক্তি ও কাঠিন্যতা জোগায়। টাফনেস ও হার্ডনেস একত্রে বজায় থাকার ফলে ভ্যানাডিয়াম ও টুলস ও বাটালি তৈরির স্টিলের একটা উল্লেখযোগ্য উপাদান। আর ঐ একই কারণে এবং ফ্যাটিগ রোধ ক্ষমতা থাকায় স্প্রীং তৈরির ইস্পাতেও ভ্যানাডিয়াম ব্যবহার করা হয়।

মোটরগাড়ির বহু পার্টস, স্প্রীং, ক্রাংক শ্যাফ্ট, অ্যাক্সল, বিভিন্ন ধরনের স্প্যানার, কাটিং টুলস ইত্যাদি ভ্যানাডিয়াম স্টিল দিয়ে তৈরি। প্রধানত ক্রোম-ভ্যানাডিয়াম, স্টিল, ম্যাঙ্গানিজ-ভ্যানাডিয়াম স্টিল, হাইস্পিড স্টিল ইত্যাদি সংকর ইস্পাত তৈরি করতে উপাদান হিসেবে এই ধাতু ব্যবহৃত হয়।

কোবাল্ট (Cobalt):

এই ধাতুর বর্ণ নীলাভ সাদা। প্রায় ১৫৫০° সেঃ তাপমাত্রায় গলে। প্রতি ঘনসেন্টিমিটার আয়তনের ওজন প্রায় ৮.৭৬ গ্রাম। কোবাল্টের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ধর্ম রেড হার্ডনেস বাড়ানো এবং ঘর্ষণজনিত ক্ষয়রোধের শক্তি জোগানো। ইস্পাতে কোবাল্ট মিশালে শক্তি ও হার্ডনেস বাড়ে কিন্তু টাফনেস কমে যায়। উন্নত জাতের হাইস্প্রিড স্টিলে শতকরা ২ থেকে ১০ ভাগ কোবাল্ট থাকে। কোবাল্টযুক্ত হাইস্পিড স্টিলকে সুপার হাইস্পিড স্টিল বলে।

মলিবডেনাম (Molybdenum):

দেখতে গ্রাফাইটের মতো। মলিবডেনাম ডাই সালফাইড (MoS) রূপে প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। এই ধাতু ভঙ্গুর ও উচ্চতাপে গলে যায়। এর জন্য বৈদ্যুতিক বাতির ফিলামেন্টের ও রেডিওর ভাল্‌ল্ভের (Electro tube) ধাতব তার হিসেবে এই ধাতু ব্যবহৃত হয়। মলিবডেনাম ইস্পাতের কাঠিন্যতা ও শক্তি বাড়ায়।

এর বিশেষ ধর্ম ক্রীপ, ফেটিগ, ও শক্ রোধ করার ক্ষমতা। সেই সাথে টাফনেস গুণ সম্পন্ন । আর এ জন্য টুল স্টিল ও হাইস্পিড স্টিলে মলিবডেনাম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

আরও পড়ুনঃ কিউপোলা চুল্লি কি? কিউপোলা চুল্লি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

অলৌহজ ধাতু সংকর (Non-ferrous Alloys):

অলৌহজ ধাতু সংকর এর তালিকা ও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

ব্রাস (Brass):

বাংলা নাম পিতল। প্রায় শতকরা ৬৭ ভাগ তামা ও ৩৩ ভাগ দস্তার মিশ্রণে পিতল উৎপাদিত হয়। এই মিশ্রণ তাম্র সংকর (Copper Alloy) এর পর্যায়ভুক্ত। দেখতে উজ্জ্বল ও হরিদ্রাবর্ণ। পিতলের মেশিনিং গুণ বৃদ্ধিও জন্য সামান্য পরিমাণের সীসা মিশাতে হয়। আর এই মিশ্রণের পরিমাণ মতো টিন মিশ্রিত করলেও পিতল উৎপন্ন হয় তা খোদাইর (Engraving) কাজে বিশেষ উপযোগী।

তামা ও দস্তার আনুপাতিক হারের উপর নির্ভর করে পিতলের গলনাঙ্ক ৯৩০° থেকে ১১০০° সেঃ পর্যন্ত হয়, আর প্রতি ঘনসেন্টিমিটার আয়তনের ওজন প্রায় ৮.১ গ্রাম। দস্তার পরিমাণ বেশি থাকলে পিতল শক্ত হয়। ৭০/৩০ পিতলের কার্টিজ ব্রাস বলে। এ দিয়ে বন্দুকের কার্তুজ তৈরি হয়।

পিতলকে উত্তমরূপে ঢালাই করা হয় বলে পিতলের উপরিভাগ আক্রান্ত হয় না বা মরিচা পড়ে না। গৃহস্থালি, বাসনপত্র, বয়লারের টিউব, রেফ্রিজারেটরের টিউব, তার, শীট, মেশিনের বুস, বিয়ারিং এবং ছোটখাটো নানা আকৃতির ঢালাই কাজ পিতল দিয়ে হয়।

ব্রোঞ্জ (Bronze):

তামার সাথে টিন ধাতুর ৯০/১০ অনুপাতে মিশালে ব্রোঞ্জ মিশ্র ধাতু তৈরি হয়। টিন খুব মূল্যবান বলে ব্রোঞ্জের দামও খুব বেশি। ব্রোঞ্জের মধ্যে দস্তা ও সীসা মিশালে তাকে গান মেটাল (Gun metal) বলে । গান মেটালে শতকরা ১৫-২০ ভাগ টিন মিশ্রিত থাকে। আর টিনের পরিমাণ ২০ ভাগ থাকলে তাকে বেল মেটাল (Bell metal) বলে। বেল মেটালকে কাঁসা বলা হয়। এই ধাতু দিয়ে ঘণ্টা তৈরি হয়। যে কাঁসাতে শতকরা ৩০ ভাগ টিন থাকে, তাকে হোয়াইট মেটাল (Whit metal) বলে।

ব্রোঞ্জের মধ্যে ১ ভাগ ফসফরাস থাকলে তাকে ফসফরাস ব্রোঞ্জ বলে। এই ধাতু কঠিন ও ক্ষয়রোধী। ব্রোঞ্জে মরিচা পড়ে না। তাই ব্রোঞ্জের মূর্তি, ট্রফি, ইত্যাদি তৈরি করা হয়। প্রায় ১১৫০° সেঃ তাপমাত্রায় ব্রোঞ্জ গলে এবং প্রতি ঘনসেন্টিমিটার আয়তনের ওজন প্রায় ৮.৬ গ্রাম। মুদ্রা, পাম্পের লাইনিং, বাসনপত্র, বুশ শীট, তার রড (Rod) ইত্যাদি ব্রোঞ্জ ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়। তামার সাথে অ্যালুমিনিয়াম মিশিয়ে অ্যালুমিনিয়াম ব্রোঞ্জ তৈরি হয়।

গান মেটাল (Gun metal):

শতকরা ৮৮ ভাগ তামা, ১০ ভাগ দস্তা মিশিয়ে গান মেটাল তৈরি হয়। বাংলা নাম ভরন। মেশিনের বিয়ারিং তৈরিতে যে গান মেটাল ব্যবহার করা হয় তাতে অল্প পরিমাণ সীসা মিশ্রিত থাকে। এই ধাতু শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী। লবণ পানিতে আক্রান্ত হয় না বলে জাহাজের প্রপেলারসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরিতে ব্যবহার হয়।

প্রায় ৬২০০ সেঃ তাপমাত্রায় গান মেটাল গলে ও প্রতি ঘন সেন্টিমিটার আয়তনের ওজন ৮.৭৩ গ্রাম। কামান, বন্দুক, বন্দুকের কার্তুজ, বয়লারের উপরিস্থ সরঞ্জাম, বিয়ারিং-এর ভাল্ব, ভাল্‌ব সীট, গ্লান্ড, পাইপ ফিটিংস, পাইপ, টিউব ইত্যাদি তৈরিতে গান মেটাল ব্যবহৃত হয়।

ফসফরাস ব্রোঞ্জ (Phosphor Bronze):

শতকরা ৭৯ ভাগ তামা, ১০ ভাগ টিন, ১ ভাগ ফসফরাস ও ১০ ভাগ সীসা মিশ্রিত করে ফসফরাস ব্রোঞ্জ উৎপন্ন হয়। ফসফরাস থাকায় গলনাঙ্ক বৃদ্ধি পায় ও উৎকৃষ্ট ঢালাই সহজতর হয়। সমুদ্রের লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত হয় না। এই ধাতু দিয়ে তার, রড, শীট তৈরি করা হয়। স্বাভাবিক তাপমাত্রায় এই ধাতুকে রোলিং অথবা ড্রয়িং করলে অধিকতর শক্ত হয় ও স্থিতিস্থাপকতা লাভ করে। আর তখন স্প্রীং তৈরি করা হয়।

আকস্মিক কম্পনরোধ ক্ষমতা থাকায় ব্রোঞ্জ দিয়ে রোলিং মিলের বিয়ারিং, রেলগাড়ির এক্সেল, মোটরযানের ক্র্যাংক শ্যাফ্ট, জাহাজের প্রপেলার ব্লেড, পাম্প রড ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

ম্যাঙ্গানিজ ব্রোঞ্জ (Manganese Bronze):

পিতলের সাথে ফেরোম্যাঙ্গানিজ (Manganese) যোগ করে এই ব্রোঞ্জ তৈরি করা হয়। নামে ব্রোঞ্জ হলেও এই ধাতুতে টিন মোটেই থাকে না। তাই কার্যত এটা পিতলই।শতকরা প্রায় ৬২ ভাগ তামা, ৩৬ ভাগ দস্তা, ১ ভাগ লোহা ও ০.৫ ভাগ ম্যাঙ্গানিজ এবং অল্প পরিমাণ কার্বন ও অ্যালুমিনিয়াম মিশিয়ে যে ম্যাঙ্গানিজ ব্রোঞ্জ তৈরি করা হয় তা প্রপেলার তৈরিতে উপযোগী। সামুদ্রিক লবণাক্ততা দ্বারা আক্রান্ত হয় না বলে জাহাজের প্রপেলার ব্লেড তৈরি হয় ও বড় বড় বিয়ারিং তৈরিতে এই ধাতু সংকর ব্যবহার হয়।

সিলিকন ব্রোঞ্জ (Silicon Bronze):

তামা, সিলিকন ও দস্তা বা ম্যাঙ্গানিজ ধাতুর মিশ্রণে সিলিকন ব্রোঞ্জ ধাতু উৎপন্ন হয়। ফসফর ব্রোঞ্জের ন্যায় অধিক শক্তিশালী ও বিদ্যুৎ পরিবাহী। সহজে মরিচা পড়ে না। এ কারণে টেলিযোগাযোগের তার এই ধাতু দিয়ে প্রচুর পরিমাণে তৈরি হয়।

অ্যালুমিনিয়াম ব্রোঞ্জ (Aluminum Bronze):

তামার সাথে ৬-১০ ভাগ অ্যালুমিনিয়াম মিশিয়ে এই ব্রোঞ্জ সংকর তৈরি করা হয়। এর বর্ণ স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল ও চকচকে। এ কারণে নকল স্বর্ণের অলঙ্কার এই ধাতু দিয়ে তৈরি হয়। লবণ পানিতে আক্রান্ত হয় না। এর স্থিতিস্থাপকতা বেশি ও ঘর্ষণরোধী।আর এজন্য বিয়ারিং ভাল্ভ, প্রপেলার ইত্যাদি এই ধাতু দিয়ে তৈরি হয়।

মনেল মেটাল (Monel metal): 

তকরা ৬৮ ভাগ নিকেল, ৩০ ভাগ তামা এবং ২ ভাগ অ্যালুমিনিয়াম সিলিকন, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি মিশিয়ে এই ধাতু তৈরি হয়, আর মূলত এটা নিকেল ব্রোঞ্জ (Bronze)। এই ধাতু ক্ষয়রোধকারী ও ইস্পাতের ন্যায় শক্তিশালী। রাসায়নিক দ্রব্য, স্টীম টারবাইনের ব্লেড, মুদ্রা (Coin) পাম্পের প্রপেলার ইত্যাদি তৈরিতে এই ধাতু ব্যবহৃত হয়।

ডেল্টা মেটাল (Delta metal):

শতকরা প্রায় ৬৬ ভাগ তামা, ৩২ ভাগ দস্তার সাথে ২ ভাগ লোহা, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ মিশিয়ে ডেল্টা মেটাল তৈরি হয়। উত্তমরূপে রোলিং, ড্রইং ও ঢালাই করা যায় । এই ধাতু ক্ষয়রোধক, লবণ পানিতে আক্রান্ত হয় না। পানি জাহাজের বয়লার মাউন্টিং, ভাল্ভ স্পিন্ডল ও শীট (Sheet) সুপারহিটেড স্টীম ও পানির পাইপ ইত্যাদির তৈরি হয় এই ধাতু দিয়ে।

আরও পড়ুনঃ হার্ডেনিং কি? হার্ডেনিং প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

ডাউ মেটাল (Dow metal):

শতকরা ৯০ ভাগ ম্যাগনেসিয়ামের সাথে প্রায় ১০ ভাগ অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যাডমিয়াম, তামা ইত্যাদি মিশিয়ে এই ধাতু উৎপন্ন হয়। অ্যালুমিনিয়াম অপেক্ষা হালকা এবং ধাতুর প্রতি ঘনসেন্টিমিটার আয়তনের ওজন ১.৮ গ্রাম। ডাউ মেটাল নরম, তাণ্ডব (Ductile) ও শক্তি সম্পন্ন। ঢালাই, ফোর্জিং, রোলিং ও ড্রইং করা চলে। উড়োজাহাজ, মোটর গাড়ির ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশ তৈরি করতে প্রচুর পরিমাণে এই ধাতু ব্যবহৃত হয়।

ওয়াই সংকর (Y-Alloy):

শতকরা ৯২ ভাগ অ্যালুমিনিয়াম, ২ ভাগ ম্যাঙ্গানিজ, ৪ ভাগ তামা ও ২ ভাগ নিকেল মিশিয়ে এই ধাতু তৈরি হয়। ইঞ্জিনের পিস্টন, কানেক্টিং রড ইত্যাদি গঠনে এই ধাতু ব্যবহৃত হয়।

আরও পড়ুনঃ ইস্পাত কি? ইস্পাত কত প্রকার ও কি কি? ইস্পাত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

অ্যালুমিনিয়াম সংকর (Aluminum Alloy):

খাদবিহীন অ্যালুমিনিয়ামের চেয়ে অ্যালুমিনিয়াম সংকর-এর ব্যবহার বেশি ও বৈশিষ্ট পূর্ণ। এতে তামা, নিকেল, দত্তা, ম্যাঙ্গানিজ, সিলিকন ও ম্যাগনেসিয়াম প্রভৃতি উপাদান বিভিন্ন অনুপাতে মিশ্রিত করে নানাবিধ অ্যালুমিনিয়াম সংকর প্রস্তুত করা হয়। এছাড়াও গুণগত মান উন্নয়নের জন্য ক্রোমিয়াম, টাইটেনিয়াম, টিন, নিকেল ইত্যাদি মিশ্রিত করে সংকর তৈরি করা হয়। তৈজসপত্র, ইঞ্জিনের ক্র্যাংকেস পিস্টন, মোভিং পার্টস, উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ, দরজা-জানালার কাঠামো ইত্যাদি অ্যালুমিনিয়াম সংক্রর দিয়ে তৈরি হয়।

সবচেয়ে ভারী ধাতু কোনটি?

সবচেয়ে ভারী ধাতু হলোঃ- পারদ।

ভারী ধাতু সাধারণত সেই ধাতুসমুহ যাদের ঘনত্ব, পারমাণবিক ভর অথবা পারমাণবিক সংখ্যা অনেক বেশি। ভারী ধাতু হওয়ার মানদন্ড বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হয়। যেমনঃ ধাতুবিদ্যায় ঘনত্বের ভিত্তিতে সঙ্গায়িত করা হয়, পদার্থ বিজ্ঞানে যেখানে পারমাণবিক সংখ্যাই পার্থক্য নির্ণায়ক।

আরও পড়ুনঃ সংকর ধাতু কী? সংকর ধাতু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url