ওহমের সূত্র সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা | Ohm's Law Explanation
বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী জর্জ সাইমন ওহম (Georg Simon Ohm) ১৮২৬ সালে বিভব পার্থক্য (V), প্রবাহমাত্রা (I) ও রোধ (R) এর মধ্যে একটি সম্পর্ক সূচক সূত্র প্রকাশ করেন। তাঁর নামানুসারে এই সূত্রের নামকরণ করা হয় Ohm’s Law বা ওহমের সূত্র।
সূত্রটি হল:-
"নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কোন একটি পরিবাহীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রবাহমাত্রা পরিবাহীর দুই প্রান্তের মধ্যকার বিভব পার্থক্যের সমানুপাতিক এবং রোধের ব্যাস্তানুপাতিক"
ওহমের সূত্রের ব্যাখ্যাঃ
এখানে সমানুপাতিক বলতে বোঝায়, যদি পরিবাহীর দুই প্রান্তের বিভব পার্থক্যকে দ্বিগুণ করা হয় তাহলে পরিবাহীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বিদ্যুৎ প্রবাহ দ্বিগুণ হবে। আবার যদি পরিবাহীর দুই প্রান্তের বিভব পার্থক্য এক তৃতীয়াংশ করা হয় তাহলে পরিবাহীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বিদ্যুৎ প্রবাহ এক-তৃতীয়াংশ হবে।
যদি কোন পরিবাহির মধ্য দিয়ে I প্রবাহমাত্রা প্রবাহিত হয়, ওই পরিবাহীর দুই প্রান্তের বিভব পার্থক্য V হয় এবং রোধ যদি R হয়, তাহলে ওহম এর সূত্রানুসারে,
V=IR
বা I = V / R
এখানে,
I = প্রবাহমাত্রা (অ্যাম্পিয়ার),
V = বিভবপার্থক্য (ভোল্ট),
R = রোধ (ওহম)।
যেহেতু, I = V / R অর্থাৎ, প্রবাহমাত্রা = বিভব পার্থক্য / রোধ,
অর্থাৎ, বিভব পার্থক্য বাড়লে প্রবাহমাত্রা বাড়বে ও বিভব পার্থক্য কমলে প্রবাহমাত্রা কমবে এবং রোধ বাড়লে বিদ্যুৎ প্রবাহমাত্রা কমবে এবং রোধ কমলে প্রবাহমাত্রা বাড়বে।
আরও পড়ুনঃ ট্রান্সফরমার কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত আলোচনা
বিভব পার্থক্য, প্রবাহমাত্রা ও রোধের মধ্যে সম্পর্কঃ
নিচের চিত্রের সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। এর সাহায্যে খুব সহজে ওহমের সূত্রকে মনে রাখা যায়। চিত্রে দেখা যাচ্ছে বিভব পার্থক্য প্রবাহমাত্রাকে প্রবাহিত করার জন্য একটা বল প্রয়োগ করছে আর রোধ তার ক্ষমতা অনুযায়ী বেচারা প্রবাহমাত্রাকে বাধা দিচ্ছে। তাই এখানে,বিভব পার্থক্য যত বেশি হবে প্রবাহমাত্রা তত বেশী হবে। রোধ যত বেশি বাধা দেবে প্রবাহমাত্রা তত কম হবে।
ত্রিভুজের সাহায্যে ওহমের সূত্র নির্ণয়ঃ
৩ নং চিত্রে ত্রিভুজের সাহায্যে খুব সহজেই ওহমের সূত্র হতে V, I, R নির্ণয় করা যায়।
প্রথমে একটি ত্রিভুজ অংকন করবো। ত্রিভুজকে চিত্রের মতো তিনটি ভাগে ভাগ করে নেবো। উপরের ভাগে থাকবে V (বিভব পার্থক্য) এবং নিচের দুইটি ভাগে I (প্রবাহমাত্রা ) ও R (রোধ)। উপরের ত্রিভুজ হতে সূত্র নির্ণয় করার সময় প্রথমে যার সূত্র নির্ণয় করতে চাই তাকে নির্বাচন করবো এবং তার সমান হিসেবে বাকি দুটিকে নেবো। বাকি দুটি যদি পরস্পর পাশাপাশি থাকে তাহলে তাদেরকে পরস্পর গুণ আকারে প্রকাশ করবো এবং পরস্পর যদি উপর নিচে থাকে তাহলে ভাগ আকারে প্রকাশ করবো।
এবার আমরা ত্রিভুজ চিত্রের সাহায্যে V, I ও R নির্ণয় করা শিখবো।
V নির্ণয়ঃ
যেহেতু আমরা V নির্ণয় করবো তাই প্রথমে আমরা ত্রিভুজ হতে V নির্বাচন করবো এবং এর সমান হিসেবে বাকি দুইটি ভাগের I ও R নেব যেহেতু বাকি দুইটি অংশে I ও R পাশাপাশি রয়েছে।
সুতরাং, V = I x R
I নির্ণয়ঃ
একই নিয়মে আমরা এবার ত্রিভুজ হতে প্রবাহমাত্রা হিসেবে I কে সিলেক্ট করব। সিলেক্ট করার পর দেখতে পাচ্ছি যে, V ও R উপর-নিচে অবস্থান করছে। সেহেতু এদেরকে ভাগ আকারে প্রকাশ করতে হবে।
সুতরাং, I = V / R
R নির্ণয়ঃ
একই ভাবে আমরা এবার ত্রিভুজ হতে রোধ হিসেব R কে সিলেক্ট করবো। এবার দেখতে পাচ্ছি যে, V ও I উপর-নিচে অবস্থান করছে। সেহেতু এদেরকেও ভাগ আকারে প্রকাশ করতে হবে।
সুতরাং, R = V / I
ওহমের সূত্রের ব্যবহারঃ
১। ডি.সি. সার্কিটে ব্যবহার করা হয়।
২। সার্কিটের প্রবাহমাত্রা (I) নির্ণয় করে তারের মাপ নির্ণয় করতে ব্যবহার করা হয়।
৩। সরল সার্কিটে বেশি ব্যবহার করা হয়।
৪। রেজিষ্টিভ লোড অর্থাৎ বাল্ব, ইলেক্ট্রিক আয়রন, হিটার ইত্যাদিতেও এর ব্যবহার রয়েছে। আর এই সম্পর্ক থেকে রোধ, প্রবাহমাত্রা আর বিভব পার্থক্যের মান নির্ণয় করা যায়।
আরও পড়ুনঃ কন্ডাক্টর, সেমিকন্ডাক্টর ও ইনসুলেটর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা
ওহমের সূত্রের সীমাবদ্ধতাঃ
১. ওহমের সূত্র DC এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, AC এর ক্ষেত্রে নয়।
২. তাপমাত্রা পরিবর্তন হলে ওহমের সূত্র প্রযোজ্য নয়।
৩. তাপমাত্রা স্থির থাকলেও সিলিকন কার্বাইডের ক্ষেত্রে ওহমের সূত্র প্রযোজ্য নয়।
৪. জটিল সার্কিট সমূহ ওহমের সূত্রের সাহায্যে সমাধান করা যায় না।
জর্জ সাইমন ওহমের শিক্ষাজীবনঃ
শৈশব থেকে জর্জ ও তার ভাই মার্টিনকে পড়াতেন তার বাবা। তারা দুজনেই গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন ও দর্শন বিষয়ে ভালো ফল করেন। জর্জ ওহম ১১ থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত এরলাঙেন জিমনেসিয়াম থেকে বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন, যা তারা দুই ভাই তাদের বাবার কাছ থেকে যা শিখেছিলেন।
জর্জ সাইমন ওহমের বাবা যখন বুঝতে পারলেন তার সন্তান শিক্ষার সুযোগ নষ্ট করছে, তখন তিনি তাকে সুইজারল্যান্ডে পাঠিয়ে দেন। সেখানে ১৮০৬ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি গণিতের শিক্ষক হিসেবে গোট্স্টাড বেই নিডাউ স্কুলে যোগদান করেন।
কার্ল ক্রিস্টিয়ান ফন লাংস্ডর্ফ ১৮০৯ সালের শুরুর দিকে এরলাঙেন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে হেইডেলবের্গ বিশ্ববিদ্যালয় এ চলে যান। ওহম ও তার সাথে হেইডেলবের্গ চলে যান এবং নতুন করে গণিত চর্চা শুরু করেন। লাংস্ডর্ফ তাকে তার নিজের মত করে গণিত চর্চা করতে উপদেশ দেন এবং তাকে লেওনার্ড অয়লার, পিয়ের সিমোঁ লাপ্লাস, ও সিলভেস্ত্রে ফ্রাসোয়া লাক্রোইক্সের গবেষণাপত্র পড়তে বলেন। ওহম তার উপদেশ মেনে নেন কিন্তু ১৮০৯ সালের মার্চে গোট্স্টাড মন্টেশরির শিক্ষকের পদ ছেড়ে দিয়ে নিউশাটেলে প্রাইভেট শিক্ষক হিসাবে শিক্ষকতা শুরু করেন। দুই বছর তিনি প্রাইভেট শিক্ষক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করেন এবং লাংস্ডর্ফের উপদেশানুসারে তিনি তার গণিত চর্চা চালিয়ে যান। পরবর্তীতে ১৮১১ সালের এপ্রিলে তিনি এরলাঙেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন।
এরপর পদার্থবিদ্যা ও গণিতের উপর প্রচুর গবেষণা করেন। আবিস্কার করেন কালজয়ী ওহমের সূত্র।
জর্জ সাইমন ওহম ১৭৮৯ সালে ১৬ মার্চ আজকের জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি খুব গরীব পরিবারের সন্তান ছিলেন এবং ১৮৫৪ সালের ৬ জুলাই বিজ্ঞানী জর্জ সাইমন ওহমের মৃত্যু হয়।
আরও পড়ুনঃ ইলেকট্রিক সার্কিটের মৌলিক ধারণা