ইলেকট্রনিক্সের কাজ করার জন্য নিজেই বানিয়ে নিন একটি অ্যাডাপ্টার

অ্যাডাপ্টার

আমরা এ পর্যন্ত যেসব প্রজেক্ট তৈরি করেছি বা ভবিষ্যতে করব, সম্ভবত সেগুলোর বেশির ভাগই চলে ব্যাটারির সাহায্যে। কিন্তু সবকিছু শুধু ব্যাটারির সাহায্যে চালানো বেশ ব্যয়বহুল এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ সমস্যারও বটে। তাই আমাদের সকলের জন্য প্রয়োজন অ্যাডাপ্টার। অ্যাডাপ্টার তৈরি করা অত্যন্ত সহজ এবং এজন্য খরচও পড়ে অত্যন্ত কম। ‘অ্যাডাপ্টার’ জিনিসটা কী, এবং এর ব্যবহার সম্বন্ধে যাঁদের তেমন ধারণা নেই তাঁদের জন্য একটু ব্যাখ্যা করে বলছি। বিদ্যুৎপ্রবাহ মূলত দুই ধরনের। একটি হলো এসি (AC-Alternate current) এবং অন্যটি ডিসি (DC-Direct current)।

এসি (AC): এসি হলো দিক-পরিবর্তী বিদ্যুৎপ্রবাহ । অর্থাৎ, এসি বিদ্যুৎপ্রবাহ ক্রমাগত দিক পরিবর্তন (সামনে-পিছনে) করতে করতে প্রবাহিত হয়। আমাদের দেশে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় তার দিক পরিবর্তনের হার হলো সেকেণ্ডে ৫০ বার। অর্থাৎ, ৫০ সাইকেল/সেকেণ্ড বা ৫০ হার্জ। যেহেতু এ-ধরনের বিদ্যুৎপ্রবাহ ক্রমাগত দিক পরিবর্তন করে সেহেতু সূক্ষ্ম ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে তা ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তাছাড়া আমাদের দেশে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় তা হলো ২২০ ভোল্ট। কিন্তু আমাদের ব্যবহৃত অধিকাংশ ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি চলে ৩ থেকে ১৫ ভোল্টে। তাই সরাসরি ২২০ ভোল্টের এসি বিদ্যুৎপ্রবাহ আমরা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি চালাতে ব্যবহার করতে পারি না।

ডিসি (DC): ডিসি হলো দিক-অপরিবর্তী বিদ্যুৎ প্রবাহ। অর্থাৎ এ প্রবাহ কোনরকম দিক পরিবর্তন না করে সরাসরি প্রবাহিত হয়। এ প্রবাহ ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ব্যাটারি থেকে যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় তা হলো ডিসি। এ কারণে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য আমরা সাধারণত ব্যাটারি ব্যবহার করে থাকি। ডিসি প্রবাহে পজিটিভ (+) ও নেগেটিভ (-) প্রান্ত রয়েছে যা আমরা ব্যাটারিতে লক্ষ করে থাকি।  এসি ও ডিসি বিদ্যুৎপ্রবাহের মৌলিক পার্থক্যগুলো নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন।

এখন, যেসব ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যাটারি অর্থাৎ ডিসি বিদ্যুৎ প্রবাহে চলে সেগুলোকে আমরা বাড়িতে সরবরাহকৃত ২২০ ভোল্টের এসি প্রবাহের সাহায্যে চালাতে চাইলে যে যন্ত্রের সাহায্য নিই সেটিই হচ্ছে অ্যাডাপ্টার। 

সুতরাং বুঝতেই পারছেন, অ্যাডাপ্টারের কাজ হলো ২২০ ভোল্ট এসি প্রবাহকে রূপান্তর করে গ্রহণযোগ্য পরিমাপের (যেমন: ৩ ভোল্ট, ৯ ভোল্ট ইত্যাদি) ডিসি প্রবাহে নিয়ে আসা। আমরা আমাদের হবি প্রজেক্টগুলো ছাড়াও রেডিও, ওয়াকম্যান, ক্যালকুলেটর ইত্যাদি যেসব জিনিস ব্যাটারির সাহায্যে চালাই সেগুলো ইচ্ছে করলে অ্যাডাপ্টরের সাহায্য নিয়ে বাড়ির ২২০ ভোল্ট এসি প্রবাহ দিয়েও চালাতে পারব।

এখন অ্যাডাপ্টর কীভাবে তৈরি করতে হয় তা শেখার আগে নতুন দু'ধরনের পার্টস সম্বন্ধে ধারণা লাভ করে নিন যা আমাদের অ্যাডাপ্টর তৈরিসহ আরও অন্যান্য অনেক কাজে লাগবে।

ট্রান্সফরমার এমন একটি যন্ত্র যার কাজ হলো ভোল্টেজের রূপান্তর করা। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট পরিমাপের ভোল্টেজকে অন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাপের ভোল্টেজে নিয়ে যাওয়া। ট্রান্সফরমার মূলত দু'ধরনের—

১. উচ্চধাপী ট্রান্সফরমার (STEP-UP TRANSFORMER) এবং

২. নিম্নধাপী ট্রান্সফরমার (STEP-DOWN TRANSFORMER)।

উচ্চধাপী ট্রান্সফরমারের কাজ হলো নিম্ন ভোল্টেজকে উচ্চ ভোল্টেজে রূপান্তর আর নিম্নধাপী ট্রান্সফরমারের কাজ হলো উচ্চ ভোল্টেজকে নিম্ন ভোল্টেজে রূপান্তর। অ্যাডাপ্টার তৈরির জন্য স্বাভাবিক কারণেই আমরা নিম্নধাপী ট্রান্সফরমার ব্যবহার করব।

ট্রান্সফরমার বাস্তবে দেখতে নিচের ছবির মত।

ট্রান্সফরমার

এবং ডায়াগ্রামে দেখতে নিচের ছবির মত।



এই সাঙ্কেতিক চিহ্নের সাহায্যে একে প্রকাশ করা হয়। লোহার কোরের ওপর ইনস্যুলেটেড তারের দুটি কয়েল স্থাপনের সাহায্যে ট্রান্সফরমার তৈরি করা হয়। কয়েল দু'টির একটিকে বলে মুখ্য কয়েল (Primary Coil) এবং অন্যটিকে বলে গৌণ কয়েল (Secondary Coil)। বাজারে বিভিন্ন ভোল্টের ট্রান্সফরমার পাওয়া যায়। অর্থাৎ, ৯ ভোল্টের একটি ট্রান্সফরমার কিনে সেটির প্রাইমারি কয়েলে ২২০ ভোল্ট সরবরাহ করলে সেকেণ্ডারি কয়েল থেকে নয় ভোল্ট বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাবে। এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছেন ট্রান্সফরমারই হলো অ্যাডাপ্টারের মূল যন্ত্রাংশ।ট্রান্সফরমারের প্রাইমারি কয়েলে যেহেতু ২২০ ভোল্ট ‘এসি’ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে সেহেতু এর সেকেণ্ডারি কয়েলে প্রাপ্ত সরবরাহও হবে ‘এসি’ বিদ্যুৎপ্রবাহ।

সুতরাং সেকেণ্ডারি কয়েলে প্রাপ্ত এসি সরবরাহকে ডিসিতে রূপান্তরিত করতে পারলেই তৈরি হয়ে যাবে আমাদের অ্যাডাপ্টার।

ডায়োড (Diode):

‘এসি’কে ‘ডিসি’তে রূপান্তর করাই হলো ডায়োডের কাজ। এটি বাস্তবে দেখতে নিচের ছবির মত।

এর পজিটিভ-নেগেটিভ প্রান্ত রয়েছে। যে প্রান্তে একটি রুপালি ব্যাণ্ড রয়েছে সেটি পজিটিভ প্রান্ত এবং অন্য প্রান্তটি হলো নেগেটিভ। 

ডায়াগ্রামে এটিকে নিচের ছবির মত সাঙ্কেতিক চিহ্নের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়।

সাঙ্কেতিক চিহ্নে পজিটিভ-নেগেটিভ প্রান্তও ছবিতে দেখানো হলো (যদিও ডায়াগ্রামে পজিটিভ-নেগেটিভ চিহ্নদুটি দেয়া হয় না)। লক্ষ করুন, তীরচিহ্নের অভিমুখী দিকটিই হলো পজিটিভ । বিভিন্ন নম্বর (যেমন: 1N4001, 1N5400, 1N914 ইত্যাদি) ডায়োডের পরিচয় বহন করে যা সাধারণত এর গায়ে লেখা থাকে। এই পার্টসটি রেকটিফায়ার নামেও পরিচিত।

ডায়াগ্রাম-১:

অ্যাডাপ্টার সার্কিট ডায়াগ্রাম

প্রথমে ডায়াগ্রাম-১ এ লক্ষ করুন। দেখতে পাচ্ছেন, ট্রান্সফরমারটির প্রাইমারি কয়েলটিতে ২২০ ভোল্ট এসি বিদ্যুৎ সরবরাহ করলে সেকেণ্ডারি কয়েলটিতে ৯ ভোল্ট এসি বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। এই প্রান্তের সাথে 1N4001 নম্বরের চারটি ডায়োড ডায়াগ্রাম অনুসারে সংযোগ করুন। আর তাহলেই এসি ৯ ভোল্ট রূপান্তরিত হবে ডিসি ৯ ভোল্টে। এখন, পাওয়ার সাপ্লাইয়ের পজিটিভ-নেগেটিভ প্রান্তের মাঝে যে ক্যাপাসিটরটি রয়েছে তা ব্যবহার করা হয় ফিল্টার করার জন্য। তাই ক্যাপাসিটরটি যত বেশি মানের ব্যবহার করবেন তত বেশি ফিল্টারিং হবে, আর এর ফলে খুব ভাল ডিসি সাপ্লাই পাবেন। ডায়াগ্রামের একটি স্থানের পাশে ক্রস (X) চিহ্ন লক্ষ করে থাকবেন। ক্রস চিহ্নের পাশে ডায়াগ্রামের দু'টি রেখার সংযোগস্থল লক্ষ করলে, মনে হবে একটি কানেকশন আরেকটির উপর দিয়ে লাফিয়ে চলে গেছে। এর অর্থ ওই জায়গাটিতে কোন সংযোগ হবে না। সুতরাং ডায়াগ্রাম অনুসারে সঠিকভাবে পার্টস সংযোগ করলেই আপনি পেয়ে যাবেন একটি সুন্দর অ্যাডাপ্টার।

ডায়াগ্রাম-২:

অ্যাডাপ্টার সার্কিট ডায়াগ্রাম

এবার আসা যাক দ্বিতীয় ডায়াগ্রামের কথায়। বাজারে ট্রান্সফরমার কিনতে গেলে লক্ষ করবেন কিছু কিছু ট্রান্সফরমারের (ফুলওয়েভ টাইপ) সেকেণ্ডারি কয়েল থেকে তিনটি প্রান্ত বেরিয়েছে। মাঝখানের প্রান্তটি শূন্য ভোল্ট এবং দু'প্রান্তে ৯ ভোল্ট (বা আপনি যত ভোল্টের ট্রান্সফরমার কিনবেন তত ভোল্ট) ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে আপনি অ্যাডাপটরটি তৈরি করবেন দ্বিতীয় ডায়াগ্রাম অনুসারে। প্রথমটিকে বলা হয় ‘ব্রীজ পাওয়ার সাপ্লাই’ এবং দ্বিতীয়টিকে বলে ‘ফুলওয়েভ পাওয়ার সাপ্লাই'৷ উভয় ক্ষেত্রেই সমান কাজ পাওয়া যাবে। আপনি যত ভোল্টের অ্যাডাপটর চান ঠিক তত ভোল্টের ট্রান্সফরমার কিনবেন। সব মিলিয়ে আপনার খরচ পড়বে ৫৫ থেকে ৭০ টাকা। সম্পূর্ণ জিনিসটি তৈরি হয়ে গেলে তা একটি ছোট কাঠের বাক্সে স্থাপন করুন। এতে করে জিনিসটি অত্যন্ত নিরাপদ হবে। মনে রাখা দরকার, এটিতে ২২০ ভোল্ট ব্যবহার করতে হয়। এ প্রসঙ্গে একটি তথ্য আপনাদের জানিয়ে রাখি, তা হলো-মাল্টিমিটার দিয়ে যখন অ্যাডাপ্টরটির ভোল্ট মাপবেন তখন দেখতে পাবেন ট্রান্সফরমারের ভোল্ট থেকে ডিসি ভোল্ট কিছুটা (এসি ভোল্টের 1.4 গুণ) বেশি আসছে। এসি থেকে ডিসিতে রূপান্তরের সময় ফিল্টারিং ক্যাপাসিটরটির কারণে এরকম হয়ে থাকে।

নিজেই তৈরি করুন রেগুলেটেড পাওয়ার সাপ্লাই

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url