পেটের বিভিন্ন রোগ চিকিৎসা ও করণীয়

পেটের বিভিন্ন রোগ চিকিৎসা ও করণীয়

পেটের বিভিন্ন রোগ চিকিৎসা ও করণীয়ঃ

সাধারণত পেটের বেশির ভাগ সমস্যার কারণ হচ্ছে বেঠিক খাবার, অনিয়মিত ও অপরিমিত খাদ্য গ্রহণ, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে উদাসীনতা, যথেচ্ছাচার ইত্যাদি। অথচ একটু যত্ন নিলেই এবং একটু নিয়ম মেনে চললেই পেটের কিছু কিছু সমস্যার আনেকাংশে সমাধান সম্ভব। কিন্তু এত কিছুর পরেও কিছু কিছু সমস্যা আছে যা আমাদের দেহকে ক্লান্ত, দুর্বল ও অসুস্থ করে তোলে। দৈনন্দিন জীবনে নিয়ম মেনে চলার পরেও আমাদের শরীর আমাদের সাথে প্রতারণা করে থাকে। প্রথমে সামান্যভাবে হলেও যত্ন ও সঠিক চিকিৎসার অভাবে পরবর্তীতে তা জটিল আকার ধারণ করে থাকে। সেই ধরনের কিছু সমস্যা নিম্নে দেওয়া হলোঃ-

বদহজমঃ

বদহজমকে বলা চলে শারীরিক বিপত্তির এক ধরনের সংকেত। বদহজম নানারকম রোগের উপসর্গ। এটি বিশেষ কোনও রোগ নয়। যদি এমন দেখা যায় যে কারও বদহজম লেগেই আছে তবে বুঝতে হবে তার কোনও রকম শারীরিক বিপর্যয় আছে। বদহজম যদি হয় তবে নানা ধরনের রোগ দেখা দেয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, বদহজম শুনলেই ডাক্তাররা গল ব্লাডারের কিংবা লিভারের সমস্যা ধরে থাকেন। এবং অনেক ক্ষেত্রেই ডাক্তারের ধারণা ঠিক হয়। বদহজমের সাথে আরও অন্যান্য যে সব সমস্যা দেখা দেয় তা হলো- খেলেই পেটে গ্যাস হয়, পেট ফেঁপে ওঠে, পায়খানা পরিষ্কার হয় না ইত্যাদি। বদহজমের কারণ হলো, লিভার থেকে যে এনজাইমগুলো আঁসে সেগুলো যদি লিভারের দুর্বলতার কারণে খাদ্যসামগ্রী হজম করাতে না পারে তাহলেই বদহজম হয়। যারা কায়িক পরিশ্রম বেশি করেন তাদের সাধারণত বদহজম হয় না। যারা পরিশ্রম করতে চান না তারাই বেশি বদহজমে আক্রান্ত হন। যারা উপর্যুপরি ভোজন করেন, রাত জাগেন কিংবা মদ্যপান করেন এরাই বদহজমে আক্রান্ত হন বেশি। এছাড়াও ঘুমের ব্যাঘাত হলে, ব্লাড সুগার বাড়লে, দুশ্চিন্তা কিংবা লিভারের কোনও বড় অসুখ থাকলে বদহজম হয়ে থাকে। 

বদহজমের উপসর্গ হলো টক ঢেঁকুর, বমি-বমি ভাব, পায়খানার সঙ্গে গোটা গোটা সামগ্রী পড়া, বুক গলা জ্বালা করা, মাথার যন্ত্রণা এবং পেট ফাঁপা। বদহজম হলে শাক সব্‌জি সেদ্ধ করে খাওয়ালে, বিশেষ করে দাঁত ওঠার বয়সটাতে একটু নজর দিলে ব্যাপারটা এড়ানো যায়। বৃদ্ধ মানুষরাও কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগতে পারে। তাদের খাওয়া দাওয়া এবং বিশ্রামের প্রতি একটু যত্ন নিলেই এ সমস্যা থাকবে না।

লিভারের অসুখঃ

অনেক সময়ে অনেক ভাইরাসের কারণে হঠাৎ করেই লিভার অসুস্থ হয়ে পড়ে। অনেক সময় দীর্ঘদিনের অনিয়মে এবং ক্ষতিকর খাদ্য পানীয়ের প্রভাবে লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। হেপাটাইটিস হলে পেট ব্যথা, বমি ভাব, অরুচি, ক্ষুধাহীনতা, জন্ডিস ইত্যাদি দেখা যায়। এ সময় পুরোপুরি বেড রেস্ট দরকার। কেউ যদি এ্যালকোহল সেবন করে থাকেন তবে তা বন্ধ করতে হবে। লিভারের সাথে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সম্পর্ক লিভার খারাপ হলে ত্বকের ওপর এর প্রভাব পড়ে। লিভার খারাপ হলে ত্বকের রঙ পরিবর্তন হয়। জন্ডিস হলে ত্বক হলদেটে হয়ে পড়ে।

পিগমেন্টেশন লিভার খারাপ হলে মুখে ছিট ছিট দাগ হতে পারে। যাকে আমরা মেচতা বলি। শরীরে হরমোনের স্বাভাবিক ক্ষরণের তারতম্য ঘটলে (জন্মনিরোধক ওষুধ সেবন বা শারীরিক ব্যধি থেকে যা হতে পারে) লিভারে অনেক সময়ই তার প্রভাব পড়ে। এর ফলে শরীরে কালো ছোপ ছোপ দাগ হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কালো ছোপ ছাড়া সাদা দাগও হতে পারে।

চুলকানিঃ

লিভার যদি কোনও কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয় তবে সমস্ত শরীরে চুলকানি হতে পারে। যেমন জন্ডিস হওয়ার আগে এবং জণ্ডিস চলাকালীন সময়ে অসম্ভব চুলকানি হয়। এই চুলকানি অন্য অসুখেও হয়ে থাকে। তবে লিভার স্বাভাবিক না থাকলেই এ রকম হয়ে থাকে।

এলার্জিঃ

হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের আক্রমণের ফলে লিভার অনেক সময় অকেজো হয়ে পড়ে। এই রোগের প্রকোপ হলে মুখে, হাতে ও শরীরের অন্যান্য অংশে নানা ধরনের গুটি দেখা যায়। একে আমরা আমবাত বলে থাকি।

শিরার স্ফীতিঃ

অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে মুখের ত্বকে মাকড়সার মতো দেখতে লাল লাল ছোপ পড়ে। হাত লাল হয়ে ওঠে। এর কারণ ত্বকের নিচে রক্তবাহী শিরাগুলো স্ফীত হয়ে রক্তক্ষরণ হয় অথবা রক্ত জমে যায়।

নখঃ

লিভার খারাপ হলে নখও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যেমন নখ ভেঙ্গে গিয়ে সাদা সাদা দাগ হওয়া ইত্যাদি লিভার খারাপেরই লক্ষণ।

হরমোনঃ

সব সময় লিভারের সমস্যায় ভুগলে হরমোনের গণ্ডগোল হয়ে থাকে। লিভার খারাপ হওয়ার কারণে হরমোনের স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। এতে করে ইস্ট্রোজেন হরমোন বেড়ে যেতে পারে। ফলে পুরুষের চুল পড়ে যায়। পৌরষহীনতা দেখা দেয়, যৌনতায় অনাসক্তি, স্তনের স্ফীতি ইত্যাদি রোগও দেখা দেয়। এভাবে লিভার খারাপ হলে ত্বকে এর প্রভাব পড়ে। আবার ত্বক খারাপ হলেও লিভারে এর প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। লিভারের সমস্যা থাকলে মুখেও দুর্গন্ধ হয়।

যাদের লিভারের সমস্যা আছে তাদের জন্য করণীয়ঃ

যাদের লিভারের সমস্যা আছে তারা তো বটেই, আবার যাদের লিভারের সমস্যা নেই তাদেরও প্রতিদিন খাওয়া দাওয়া ও নিত্যদিনের অভ্যাসের দিকে নজর দিতে হবে, তবেই আপনার লিভার থাকবে সুস্থ ও কার্যক্ষম।

১। যাদের লিভার খারাপ তারা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে এক টেবিল চামচ করলার রস খাবেন। আবার যাদের লিভার ভাল তারা ছোট চামচের এক চামচ রস খেলেই ভাল থাকবেন।

২। ভাজাভুজি যত কম খাওয়া যায় ততই ভাল।

৩। অতিরিক্ত তেল, ঘি, মাখন কোনও অবস্থাতেই খাওয়া যাবে না।

৪। যে কোনও একটি শাকের রস (যেমন পালংশাক) খেতে পারলে ভাল। আর যদি শুধু রস খাওয়া না যায় তবে ফলের দু’একটা টুকরো কেটে তাতে দেওয়া যায় ।

৫। দুধ না খাওয়াই ভাল। আর দুধ খেতে চাইলেও ওপরের সরটা তুলে ফেলে তারপর খেতে হবে।

৬। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।

৭। শুধু খাবার নিয়ে ভাবলেই হবে না। কিভাবে রান্না হচ্ছে সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।

৮। নিয়মিত ভাবে খাদ্য গ্রহণের সাথে সাথে পর্যাপ্ত ব্যায়ামও করতে হবে। যারা খুব একটা শারীরিক পরিশ্রম করেন না তাঁদের জন্য ব্যায়াম অত্যাবশ্যক।

শিশুদের ব্যাপারে সতর্কতাঃ

শিশুদের খাবার দাবারের ব্যাপারে আমরা কড়াকড়ি করে থাকি- যখন শিশু নিতান্ত শিশু থাকে। এরপর যখন একটু বড় হয় তখন কড়াকড়ি শিথিল হয়ে যায়। প্রায়ই এমন দৃশ্য দেখা যায় যে, মা-বাবা শিশুর মুখে রাস্তার খাবার তুলে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন না। এটি ঠিক নয়, আবার অনেকে আছেন শিশুদের ফোটানো পানি খাওয়ান ঠিকই কিন্তু পানি ফোটানোর সঠিক নিয়ম তারা মেনে চলেন না। পানি ঠিক আধ ঘণ্টা ধরে ফোটাতে হবে তারপর সেই ফোটানো পানি শিশুকে খাওয়াতে হবে।

এছাড়াও শিশুদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় শিশুরা পঁচা, বাসি এবং আঢাকা খাবার খেয়ে ফেলে। তাই এ ধরনের খাবার যাতে শিশুরা না খেতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আবার এমনও দেখা যায় অত্যন্ত ছোট শিশু মাটিতে খেলাধূলা করতে করতে মুখে হাত দিয়ে দেয় এতে করে শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে।

আলসারঃ

পেটের যে বিভিন্ন রোগ রয়েছে এর মধ্যে আলসার একটি বড় রোগ। আলসার একদিনে হয় না আবার হঠাৎ করে কোনও সমস্যাও দেখা দেয় না। বিভিন্ন কারণে পেটের ভেতরে যদি কোনও সমস্যা থাকে, তবে তা ধীরে ধীরে আলসারের দিকে এগিয়ে যায়। আলসার হলে প্রথম প্রথম বদহজম হয়, বুক জ্বালা করে এবং টক ঢেঁকুর ওঠে। এ ধরনের উপসর্গ অতি সাধারণ এবং এত মানুষের মধ্যে এ ধরনের উপসর্গ রয়েছে যে, ব্যাপারটাকে আমরা তেমন গুরুত্ব দেই না। এ ধরনের সমস্যা হলেই আমরা এন্টাসিড খেয়ে নেই। এভাবে এন্টাসিড খাওয়াটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। এরপর আমরা যখন দেখি আমাদের রোগ ভাল হচ্ছে না তখনই আমরা ডাক্তারের কাছে ছুটে যাই।

আলসারের কারণঃ

আমাদের পাকস্থলী কিংবা স্টমাকে যদি কোনও ভাবে এসিড বেশি উৎপন্ন হয় তাহলেই আলসার দেখা দেয়। অনেক সময় গলব্লাডারে পাথর হওয়ার জন্যও এ রকম হয়ে থকে। প্রতিটি মানুষের পাকস্থলীতে কিছু ব্যাকটেরিয়া থাকে। অনেক সময় এই ব্যাকটেরিয়া থেকে আলসার হয়। আবার খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম কিংবা অতিরিক্ত টেনশন থেকেও আলসার হয়ে থাকে।

আলসারের লক্ষণঃ

১। গলা, বুক ও পেট জ্বালা করে।

২। ওপরের পেটের মাঝখানে কিংবা সামান্য ডান দিকে ব্যথা হয়।

৩। পেট যখন খালি থাকে তখনই ব্যথা বাড়ে।

৪ । কিছু খেলে কিংবা যখন এন্টাসিড খাওয়া হয় তখন জ্বালা কমে যায়।

৫। অনেক সময় রক্ত বমি বা কালো পায়খানা হতে পারে।

আলসারের প্রকারভেদঃ

আলসার সাধারণত দু'রকমের হয়ে থাকে। পেটের যে কোনও আলসারকেই ডাক্তারি পরিভাষায় পেপটিক আলসার বলা হয়ে থকে। পেপটিক আলসারের দুটো ভাগ রয়েছে। এর একটি হচ্ছে

ডিয়োডিনাল আলসারঃ এই আলসার পাকস্থলীতে হয় না এবং এটি অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর। এ আলসারের থেকে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা নিরানব্বই ভাগ ক্ষেত্রেই থাকে না।

গ্যাস্ট্রিক আলসারঃ এই আলসার পাকস্থলীর মধ্যে হয় এবং এই আলসার হলে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। এই আলসার হলে রক্ত বমি হয় এবং শরীরের ওজন কমে যায়। ক্ষুধা কমে যায় এবং ওপরের পেটে ব্যথা থাকে। এভাবে কোনও না কোনও কষ্ট লেগেই থাকে। ঠিক সময়ে যদি এ আলসারের চিকিৎসা না হয় তবে এর থেকে ক্যান্সারও হয়ে যেতে পারে।

আলসার হলে করণীয়ঃ

১ । নিয়মিত ভাবে এবং ঠিক সময়মত খাওয়া দাওয়া করতে হবে।

২। যদি মনে করে থাকেন যে, আলসার হয়েছে তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৩। নিয়মিত ও সময়মত ঘুমোতে হবে। দুঃশ্চিন্তা পরিহার করতে হবে।

৪। আস্তে আস্তে চিবিয়ে খাবার গ্রহণ করতে হবে। চিবানো একটি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য হজমের কাজের অংশবিশেষ। মুখের লালায় যে এনজাইম আছে তা খাদ্যকে সহজপাচ্য করে এবং পাকস্থলীর হজম শক্তিকে সহায়তা করে।

আলসার হলে কি করা উচিত নয়?

১। অকারণ টেনশন পরিহার করুন।

৩। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাবেন না।

৪। কোনও অবস্থাতেই মদ্যপান করবেন না।

৫। ধূমপান বন্ধ করুন।

৬। অনুসন্ধান করুন কোন্ কোন্ খাদ্য আপনার পাকস্থলীকে অশান্ত করে এবং যথাসম্ভব তা এড়িয়ে চলুন।

৭। হালকা মশলাযুক্ত খাবার আলসারের রোগী খাবেন। যে সকল খাবার সহজপাচ্য এবং ঝালবিহীন তরল খাবার খাবেন।

৮ । অতিরিক্ত ঝাল, টক এবং মশলাযুক্ত খাবার বর্জন করুন।

৯। চটপটি, ফুচকা ইত্যাদি খাবার খেলে আলসার তো হতেই পারে সেই সাথে জণ্ডিস এবং টাইফয়েডও হতে পারে।

অন্যান্য কিছু নিয়মঃ

জীবনযাত্রাকে নিয়মমাফিক করা উচিত, গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়মমাফিক বলে তাদের এ ধরনের রোগ কম হয়। পক্ষান্তরে শহরের জীবন টেনশনের এবং প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ওষুধ সেবনের কারণেও এ ধরনের রোগ হয়ে জীবনকে দূর্বিসহ করে তুলছে। এজন্য কিভাবে মনোদৈহিক রিলাক্সড অনুভব করবেন তা শিখে নিয়ে মানসিক চাপ কমাবেন। নিয়মিত ব্যায়ামের চেষ্টা করুন কিন্তু কোনও কষ্টসাধ্য কাজ করবেন না যা আপনি সহ্য করতে পারেন না। মৃদু ব্যায়াম আপনাকে সাহায্য করবে মানসিক ও শারীরিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে।

কোষ্ঠকাঠিন্যঃ

আমাদের দেহের বিশেষ করে পেটের নানাবিধ অসুখের জন্যই কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে থাকে। যেমন- খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম, ভেজাল খাদ্য গ্রহণ এবং খাওয়া দাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তনের ফলেই রোগটি হয়ে থাকে। মানুষের ভেতর উদ্বেগ টেনশন বেড়ে যাওয়াতে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। কারণ মানুষ যখন অতিমাত্রায় টেনশন করে তখন মানুষের মধ্যে হজমের গোলযোগ দেখা দেয়। এতে করে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রোগ বাসা বাঁধে। এ ধরনের অনেকগুলো অসুখ বিসুখের মধ্যে কোষ্ঠকাঠিন্যও একটি রোগ। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে হজমের গন্ডগোল ঘটে। পুরনো দিনের লোকেরা নিয়ম কানুন মেনে চলতো, যেমন— নিয়ম করে শুয়ে পড়া, ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, শারীরিক শক্তি ব্যয় করা, শারীরিক শক্তি ব্যয় হয় এমন কাজ করা। বর্তমানে এসব অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। অনেকেই রাত জেগে কাজকর্ম করে থাকেন এবং অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠে থাকেন। কায়িক পরিশ্রমের চাইতে এখন মানসিক পরিশ্রমই বেশি করে থাকেন।

 আবার শিশুদের ক্ষেত্রে কোষ্ঠকাঠিন্যের আরেকটা কারণ হচ্ছে কৌটোর দুধ। যেসব মা শিশুদের স্তন্যপানের পরিবর্তে কৌটোর দুধ পান করিয়ে থাকেন এসব শিশুদেরও কোষ্ঠকাঠিন্য হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন দেখে শিশুদের যে কোনও জিনিস খেতে দেওয়া উচিত নয়। বাসি খাবার খেতে দেওয়াও উচিত নয়। শিশুদের পেট ঠিক রাখতে হলে মাঝে মধ্যে কাঁচা কলা ও কাঁচা পেঁপে সেদ্ধ করে খাওয়ানো উচিত। শিশুদের পেটে যদি সামান্য গন্ডগোল দেখা দেয় তবে সাথে সাথে ওষুধ খাওয়ানো ঠিক নয়। অনেক সময় বদহজম থেকে পেট খারাপ হয়ে থাকে। আবার আপনা আপনিই সেরে যায়। তবে ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হলে অতি সত্বর ডাক্তার দেখাতে হবে। ঘন ঘন এন্টাসিড খাওয়া ঠিক নয়। এন্টাসিডের অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে যা শরীরের ক্ষতি করে থাকে ।

ডায়রিয়াঃ

ডায়রিয়া কি?

২৪ ঘণ্টায় ৩ (তিন) বা তারও বেশি বার পাতলা পায়খানা হওয়াকে ডায়রিয়া বলে।

ডায়রিয়াতে শরীরে কী সমস্যা হয়?

ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুর শরীর থেকে পানি ও লবণ বের হয়ে যাওয়ার ফলে শিশুর পানিস্বল্পতা দেখা দেয়। সঠিক চিকিৎসা না করালে শিশুর মৃত্যুও হতে পারে।

ডায়রিয়া চিকিৎসায় জিংক কীভাবে কাজ করে?

ডায়রিয়ার তীব্রতা কমায় ও ডায়রিয়া দ্রুত সারায়। আন্ত্রিক কোষসমূহের ডায়রিয়াজনিত ক্ষতকে দ্রুত সারিয়ে তোলে। অন্ত্রের পানি ও খনিজ লবণ শোষণ ক্ষমতা বাড়ায়। শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

ডায়রিয়া চিকিৎসায় কী মাত্রায় (ডোজে) জিংক ব্যবহার করতে হবে?

● ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুর জন্য জন্য ২০ মি.গ্রা. জিংক (ডিসপারসিবল) ট্যাবলেট প্রতিদিন
১টি করে ১০ দিনে মোট ১০টি ট্যাবলেট।

দিনে কতবার জিংক ট্যাবলেট খাওয়াবেন?

● দিনে মাত্র একবার জিংক ট্যাবলেট খাওয়াবেন।

ডায়রিয়া চিকিৎসার জন্য শিশুকে কখন ওআরএস (ORS) এবং জিংক খাওয়ানো শুরু করা উচিত?

ওআরএস (ORS) খাওয়ানোর নিয়ম আধা লিটার ১/২ পরিষ্কার পানি জগ অথবা পাত্রে নিয়ে তার মধ্যে এক প্যাকেট ওআরএস মিশাতে হবে।

• দুই বছরের নিচে শিশুদেরকে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পরে ৫০-১০০ মিলি অথবা ১০-২০ চা চামচ ওরস্যালাইন খাওয়াতে হবে।
• দুই বছরের উর্দ্ধে শিশুদেরকে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পরে ১০০-২০০ মিলি অথবা ২০-৪০ চা
চামচ ওরস্যালাইন খাওয়াতে হবে। শিশুর ডায়রিয়া শুরু হওয়ার সাথে সাথেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খাবার স্যালাইন এবং জিংক ট্যাবলেট খাওয়ানো শুরু করা উচিত।

শিশুকে জিংক ট্যাবলেট খাওয়ালে স্যালাইন খাওয়াতে হবে কি?

• শিশুর পাতলা পায়খানা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত অবশ্যই খাবার স্যালাইন পানিস্বল্পতা পূরণ করে, জিংক পানিস্বল্পতা পূরণ করে না। শিশুর ডায়রিয়া বন্ধ হয়ে যাবার পর পানিস্বল্পতার চিহ্ন না থাকলে আর
খাবার স্যালাইন খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই তবে জিংক ট্যাবলেট ১০ দিন পর্যন্ত খাওয়াতে হবে।

ডায়রিয়া সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে নিচের এই আর্টিকেলটি পড়তে পারেনঃ 

বমি যখন বিব্রতকর সমস্যাঃ

বমি নির্দিষ্ট কোনও রোগ নয়। তবে এটি অনেক রোগের নির্দেশক। সাধারণত লালা নিঃসরণ এবং বমি বমিভাবই বমির প্রাথমিক স্তর। পরিপাকতন্ত্রের যে কোনও রোগের তীব্র অবস্থায় বমি হতে পারে। এছাড়া মেনিন্‌জাইটিস, ইউরেমিয়া, মাইগ্রেনের ব্যথা, আবার কিছু কিছু ওষুধ সেবন করলেও বমি হয়।

আবার ছোট শিশুদের মাঝে মাঝে পেটের গোলমালের জন্য বমি হয়ে থাকে। এ ধরনের সাধারণ বমি বিশেষ কোনও কারণে হয় না। আপনা আপনিই সেরে যায়। আবার ইনফেকশনের জন্যও বমি হয়ে থাকে।

নির্দিষ্ট রোগ নির্ণয়ে বমির প্রকারভেদঃ

১। কোনও রকম বমি বমি ভাব ছাড়া হঠাৎ বমি শুরু হলে মাথার খুলির ভেতরের রোগ নির্দেশ করে। ব্রেন টিউমারের ক্ষেত্রে এমনটি হয়ে থাকে ।

২। সকালে ঘুম ভাঙ্গলে বমি বমি ভাব হওয়া, গর্ভাবস্থা, মদ্যপান বা মানসিক উদ্বেগ নির্দেশ করে।

৩। সন্ধ্যায় কিংবা রাতে যদি প্রচুর বমি হয় এবং ২৪ ঘণ্টা পূর্বের খাদ্য অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়, তবে বুঝতে হবে পাকস্থলীর নির্গম পথে সৃষ্ট বাধার নির্দেশক।

৪ । রোগী যদি প্রচুর মদ্যপান করে কিংবা প্রচুর পরিমাণে কেক, চকোলেট কিংবা দুগ্ধজাত খাবার খেয়ে থাকে তাহলেও বমি হতে পারে।

৫। পেপ্‌টিক আলসারের কারণেও বমি হয়। আবার পাকস্থলীতে রক্তক্ষরণ হলেও বমির সাথে রক্ত যায়।

৬। পড়ে গিয়ে যদি মাথার পেছনে আঘাত লাগে কিংবা ব্রেন হেমারেজের কারণেও বমি হয়।

৭। ভ্রমণের বিড়ম্বনার কারণে অনেকে বমি করে থাকেন।

৮। বিভিন্ন ধরনের মানসিক অসুস্থতাতেও রোগী প্রায়শই বমির অভিযোগ করে থাকেন।

৯। মারাত্মক হার্ট ফেলিওর হলেও বমি হয়ে যায়।

১০। পঁচা খাবার থেকে বিষক্রিয়ার কারণে বমি হয়ে থাকে।

১১। পেটের কোনও তীব্র যন্ত্রণা বা নাড়িভুঁড়িতে কিছু আটকে গেলে বমি হয়।

১২ । এপেনডিসাইটিস থেকেও বমি হয়৷

১৩। বেশি জ্বর বা সাংঘাতিক যন্ত্রণা হলে বমি হয় যেমন- ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস, প্রস্রাবে সংক্রমণ, টনসিলে সংক্রমণ ইত্যাদি।

বমি হলে করণীয়ঃ

১। যতক্ষণ অতিমাত্রায় বমি হতে থাকবে ততক্ষণ শক্ত খাবার দেওয়া যাবে না।

২। রোগীকে খাবার স্যালাইন দিতে হবে।

৩ । ভ্রমণে গেলে, বমির সমস্যা হলে, ভ্রমণে যাওয়ার পূর্বে বমি বন্ধের ওষুধ খেয়ে নিতে হবে।

৪। পড়ে যাওয়ার ফলে বমি হলে মাথায় বরফ পানি ঢেলে সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

৫। গর্ভাবস্থায় ‘মর্নিং সিকনেসের' জন্য মেয়েদের বমি হয় কিংবা বমির ভাব হয়। সকালে উঠে কিছু খেয়ে ফেললেই এ উপসর্গগুলো চলে যায়।

৬। খাদ্যে যাতে বিষক্রিয়া না ঘটে এজন্য রাস্তার বাসি কিংবা পঁচা খাবার খাওয়া যাবে না।

৭। বমি যদি গাঢ়, সবুজ কিংবা খয়েরী রঙের হয় এবং তাতে যদি মলের গন্ধ থাকে তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

৮। বমি বন্ধের জন্য ওষুধ খেয়ে ৫ মিনিট অন্য কিছু খাওয়া যাবে না।

৯। বমি বন্ধ হয়ে গেলে যতক্ষণ রোগীর প্রস্রাব না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত স্যালাইন খাইয়ে যেতে হবে।

১০। বমি আর পাতলা পায়খানা যদি সাংঘাতিক রূপ ধারণ করে এবং ২৪ ঘণ্টার অধিক সময় ধরে চলে। কিংবা মুখ বা মলদ্বার দিয়ে ওষুধ দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে তবে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url