ডায়রিয়া: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের উপায়

ডায়রিয়া: কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের উপায়

অন্যান্য অনুন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও ডায়রিয়া একটি ব্যাপক স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি করেছে। সাধারণত প্রতি বছর মার্চ থেকে আরম্ভ করে মে মাস পর্যন্ত এ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়, অবশ্য বছরের অন্য সময়টাতেও এ রোগ হয়ে থাকে। সব বয়সী লোকদেরই ডায়রিয়া হতে পারে। তবে শিশুদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের শতকরা ৩০ ভাগ শিশু ডায়রিয়া ও তৎজনিত অপুষ্টির কারণে মারা যায়। প্রতি বছর প্রায় আড়াই লাখ শিশু এভাবে মারা যায়।

ডায়রিয়া কি?

২৪ ঘণ্টায় তিন বা ততোধিকবার পাতলা পায়খানা হয়ে শরীরে পানিশূন্যতা সৃষ্টি করলে তাকে ডায়রিয়া বলে। ডায়রিয়া হলে কখনও ঘন ঘন পাতলা পায়খানার সাথে বমি আরম্ভ হয়। এতে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। শিশুদের খাওয়ার প্রতি অনীহা দেখা দেয়। শরীরের ওজন কমে যায়, মায়ের দুধ যে সব শিশুরা খায় তারা দুধ খাওয়া ছেড়ে দেয়।পায়খানার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে সবুজ ও হলুদ রঙের হয়। ডায়রিয়া শুরু হলে কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যেই শিশুর শরীরে ব্যাপক পানিশূন্যতার লক্ষণ দেখা দেয়। শিশুর চোখ গর্তে ঢুকে পড়ে। মাথার সামনের দিক ভেতরের দিকে বসে যায়। নাড়ীর গতি দুর্বল হয়ে পড়ে। পেটের আকৃতি চৌকণা হয়ে যায়। হাত, পা, ঠোঁট, নাক, কান ইত্যাদি ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সমস্ত শরীর নীলাভ হয়ে আসে। সমস্ত শরীরের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে আসে।

ডায়রিয়ার প্রকারভেদঃ

সাধারণত দু'ধরনের ডায়রিয়া দেখা যায়। একুইট ডায়রিয়া- যা স্বল্প সময়ে দেখা যায়। ক্রনিক ডায়রিয়া-যা অনেকদিন ধরে ডায়রিয়া চলতে থাকে। যে কারণগুলোর ফলে ডায়রিয়া হয় সেগুলো হলো- বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াল ইনফেক্শন, এলার্জি, খাদ্যে বিষক্রিয়া, দুধের এলার্জি ইত্যাদি আরও নানাধরনের কারণ।

ডায়রিয়ার প্রতিকারঃ

ওরাল রিহাইড্রেশন— ডায়রিয়া জনিত রোগসমূহ মোকাবেলায় সিংহভাগ ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এই ওরাল রিহাইড্রেশন পদ্ধতি যদি গ্রহণ করা হয় তবে মৃত্যু সংখ্যা হ্রাস পাবে।

রিহাইড্রেশন থেরাপীঃ

বাড়িতে তৈরি ও.আর.এস বা খাবার স্যালাইন ডায়রিয়ার কারণে সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া সমূহকে ম্যানেজ করে। নব্বই শতাংশ ডায়রিয়ার রোগী এই খাবার স্যালাইন দ্বারা ম্যানেজ করা যায়। এই স্যালাইন বানানোর পদ্ধতি হচ্ছে এক চিমটি লবণ এবং এক মুঠো গুঁড় আধা লিটার পানিতে মিশিয়ে তৈরি করতে হবে। এছাড়াও বুকের দুধ, সাদা পানি, ডাবের পানি, চিড়ার পানি, লবণ-চিনির মিশ্রণ, হালকা চা, স্যুপ ইত্যাদি বাড়িতে খাবার স্যালাইন হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তবে একটি জিনিস খেয়াল রাখতে হবে এই পানিশূন্যতা যদি দূর না হয়, নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ওরাল স্যালাইন এনে খাওয়াতে হবে। খাবার স্যালাইন খেলে রোগী যদি একবার বমি শুরু করে তবে তা সহজে থামানো যাবে না। রোগীকে চারভাগের এক ভাগ খাবার স্যালাইন খেতে দিতে হবে প্রতিবার পাতলা পায়খানার পর। রোগীকে স্বাভাবিক সব খাবার দেওয়া যাবে। স্যালাইন বানানোর বারো ঘণ্টার মধ্যেই এই স্যালাইন খাওয়ানো যাবে।

চালের তৈরি খাবার স্যালাইনঃ

এই স্যালাইনে শুধুমাত্র পানিশূন্যতা দূর হয় না- এটি পুষ্টিও যোগায়। এটি বানাতে খরচও কম পড়ে। চালের তৈরি খাবার স্যালাইন, গ্লুকোজের তৈরি খাবার স্যালাইন থেকে উন্নতর। এটি শিশুর জীবন বাঁচাতে অত্যন্ত কার্যকর।

এই স্যালাইন ৫ মাস এবং তার নিচের বয়সের শিশুদের জন্য অনুপযোগী।

রোগী যদি শক্ প্রাপ্ত হয়ঃ

যে সমস্ত রোগী পাতলা পায়খানার কারণে অজ্ঞান হয়ে বা খুব বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে এদের শিরার মধ্যে স্যালাইন দিতে হবে। পরবর্তীতে রোগীর অবস্থার ওপর নির্ভর করে খাবার স্যালাইন দিতে হবে। ডায়রিয়া যদি আপনা আপনি বন্ধ না হয় তবে রোগীকে ওষুধ দিতে হবে।

শিশুকে কখন হাসপাতালে বা চিকিৎসকের নিকট প্রেরণ করবেনঃ

১। যদি আমাশয় হয় ( পায়খানায় রক্ত থাকলে )।

২। তীব্র পানিশূন্যতা হলে।

৩। তীব্র বমি হলে যখন শিশু কিছু খেতে পারে না এবং ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে।

৪। শিশুর খিঁচুনী দেখা দিলে।

৫। শিশুর প্রস্রাব ১২ ঘণ্টা কিংবা তারও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকলে।

৬। তিন দিন ধরে স্যালাইন খাওয়ানোর পরও যদি ডায়রিয়া ভাল না হয়।

বিলম্ব হলেঃ

শিশুর অপুষ্টি দেখা দিলে ওজন ও উচ্চতা বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে। শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়। শরীরে বিভিন্ন ভিটামিনের অভাব পড়ে। বিশেষ করে ভিটামিন 'এ'-র অভাবে রাতকানা রোগ হয়। অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয় এবং বৃক্কের ক্রিয়া বন্ধ হয়েও শিশু মারা যায়। তাই ডায়রিয়া সেরে গেলেও শিশুকে অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার বেশি বেশি করে খাওয়াতে হবে।

ডায়রিয়া প্রতিরোধঃ

১। খাওয়া, ধোয়া এবং রান্নার কাজে নলকূপের বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করতে হবে।

২। পায়খানা থেকে আসার পর এবং খাওয়ার পূর্বে হাত ভালভাবে সাবান কিংবা ছাই দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।

৩। নখে যাতে ময়লা না জমে সেজন্য নিয়মিত নখ কাটতে হবে।

৪। বাসি, পঁচা বা ফেলে দেওয়া খাবার কখনওই খাবেন না। খাবারে যেন

মশা-মাছি না বসে সেজন্য খাবার ঢেকে রাখতে হবে।

৫। ডায়রিয়া রোগীর পায়খানা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।

৬। বিশুদ্ধ নলকূপের পানি ব্যবহার করতে হবে। ফুটানো পানি পান করতে হবে।

৭। শিশুকে বুকের দুধ দিতে হবে এবং বুকের দুধ দেবার পূর্বে স্তন বোঁটাসহ পরিষ্কার করতে হবে।

৮। শিশুকে সঠিকভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো এবং সময়মত বাড়তি খাবার দিলে ডায়রিয়া কম হয়।

বাড়িতে নিরাপদ খাবার তৈরি করবেন কিভাবে?

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ব্যাপকভাবে রোগ সংক্রমণ হয় মাত্র কয়েকটি কারণে। এজন্য দায়ী সাধারণ ভুলগুলোর সহজে সমাধান করা যায় কিছু নিয়ম মেনে চললে।

১। শিশুর খাবার যারা তৈরি করেন, তাদেরকে খাবার তৈরির আগে পরিষ্কার পানিতে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে।

২। মলত্যাগের পর বাড়ির সকলকে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।

৩। শিশুর মল পরিষ্কার করার পরও সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।

৪। খাওয়ার পূর্বে, খাবার পরিবেশনের পূর্বে কিংবা খাবারে হাত দেওয়ার পূর্বে ভাল করে হাত ধুয়ে নিতে হবে।

৫। হাতে যদি কারও ঘা থাকে তবে ঐ হাত দিয়ে খাবার তৈরি কিংবা পরিবেশন করলে রোগ ছড়াতে পারে।

৬। রান্নার পর পরই খাবার খেয়ে নেওয়া ভাল। কারণ রান্নার পরে সময় যত বাড়তে থাকে রোগ সংক্রমণ ততো বাড়তে পারে।

৭। খাবার সব সময় ঢেকে রাখতে হবে যাতে রোগ সংক্রমণ না ঘটে।

৮। মাছি, পোকামাকড়, ইঁদুর বা অন্যপ্রাণী যাতে খাবার দূষণ করতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

৯। ভালভাবে রান্না করে খাবার খেতে হবে। ফল বা সালাদের উপকরণগুলো খাবার আগে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।

১০। রান্না করা এবং কাঁচা খাবার একত্রে রাখা যাবে না।

১১। রান্না করা খাবার যদি দু'ঘণ্টার বেশি এমনি পড়ে থাকে, তবে খাবার পূর্বে পুনরায় ফুটিয়ে নিতে হবে।

১২। রান্না ঘরের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিতে হবে। খাদ্য তৈরি ও পরিবেশনের জন্য যে সকল হাঁড়ি, পাতিল, থালা, বাটি, গ্লাস, চামচ ব্যবহার করা হয় সেগুলো বিশুদ্ধ পানিতে ধুয়ে নিতে হবে। ধোয়া মোছার কাজে যেসব কাপড় ব্যবহার করা হয় সেগুলো অবশ্যই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

১৩। ফল মূল শাক সব্‌জি ছাড়া অন্যান্য খাবার সংরক্ষণের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন সংক্রমণ না ঘটে।

১৪। পানি শুধু ফুটিয়ে খেলেই চলবে না। বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের দিকেও নজর দিতে হবে, যেমন মুখ ধোয়া, গোসল করা, থালা বাসন ধোয়া ইত্যাদি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url