ইলেকট্রনিক্স এর কাজ শুরু করার আগে যেসব বিষয় অবশ্যই জেনে রাখা প্রয়োজন

 

ইলেকট্রনিক্স

কাজের শুরুতে আমাদের বেশি কিছু জানবার প্রয়োজন নেই। প্রথম সার্কিটটি তৈরি করতে আমাদের ঠিক যতটুকু জানবার প্রয়োজন এখন আমরা ঠিক ততটুকুই শিখব। আর পরবর্তী সার্কিটগুলো তৈরি করার জন্য নতুন যে তথ্যটুকুর প্রয়োজন পড়বে তা আপনারা পেয়ে যাবেন এই ব্লগ সাইটে ঠিক তার আগেই।

আসুন তাহলে এবার মূল বিষয়ের দিকে যাওয়া যাক।প্রথমে আপনাদের কয়েক ধরনের ইলেকট্রনিক পার্টস্ বা যন্ত্রাংশ চিনে নিতে হবে। তার পরই আমরা হাতেকলমে কাজ শুরু করতে পারব।

রেজিস্টর (Resistor): 

ইলেকট্রনিক সার্কিটে যে ধরনের পার্টস সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় তার একটি হলো রেজিস্টর। এটি বাস্তবে দেখতে সাধারণত নিচের ছবির মত।

রেজিস্টর (Resistor)
রেজিস্টর

বিদ্যুৎপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করাই এর কাজ। এটি ঠিক কতটুকু বাধা সৃষ্টি করবে তা নির্ভর করে এর মানের ওপর। এর মানের একক ওহম(ohm)। ওহম-এর সাঙ্কেতিক চিহ্ন Ω। একেকটি রেজিস্টরের মান বোঝা যায় এর গায়ে যে কালার-কোড (colour code) থাকে তা থেকে। এই কালার কোড কিভাবে পড়তে হয় তা যথাসময়ে ব্যাখ্যা করা হবে। একটি সার্কিটের ডায়াগ্রাম (সাঙ্কেতিক চিত্র) আঁকার সময় রেজিস্টরের যে সাঙ্কেতিক চিহ্ন ব্যবহার করা হয় তা নিচের ছবির মত।

রেজিস্টরের সাঙ্কেতিক চিহ্ন

 ডায়াগ্রামে সাঙ্কেতিক চিহ্নের পাশে ওই রেজিস্টরের মান লেখা থাকে; যেমন: 100Ω, 2.2 Kilo Ω(সংক্ষেপে 2.2 KΩ) ইত্যাদি। একই মানের রেজিস্টরের আবার বিভিন্ন ওয়াট হতে পারে। ডায়াগ্রামে উল্লেখ না থাকলে বুঝতে হবে রেজিস্টরটি 1/4 W (কোয়ার্টার ওয়াট)-এর। অর্থাৎ রেজিস্টর কেনার সময় মান বলা সত্ত্বেও দোকানি যদি সেটার ওয়াট জানতে চায় তবে বলবেন 1/4W ।

ক্যাপাসিটরঃ

(Capacitor): ইলেকট্রনিক্সে রেজিস্টরের পর আর যে যন্ত্রাংশটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সেটি হলো ক্যাপাসিটর। এগুলো দেখতে সাধারণত নিচের  ছবির মত।

ক্যাপাসিটর
ক্যাপাসিটর

বিদ্যুৎ বা চার্জ ধারণ করাই এর কাজ। এটিরও বিভিন্ন মান হয়ে থাকে এবং এই মান এর গায়ে লেখা থাকে। এর একক হলো ফ্যারাড (Farade)। অবশ্য ইলেকট্রনিক্সে ব্যবহৃত ক্যাপাসিটরগুলো সাধারণত খুব অল্প মানের হয়ে থাকে । যেমন মাইক্রো-ফ্যারাড ( μF ), ন্যানো-ফ্যারাড (nF), পিকো- ফ্যারাড (pF) ইত্যাদি।এর দু'টি পা-এর মধ্যে একটি পজিটিভ ও অপরটি নেগেটিভ যা ক্যাপাসিটরের গায়ে চিহ্নিত থাকে। সাধারণত যে পা-টি নেগেটিভ সেটির সোজাসুজি একটি মোটা কালো দাগ ('—' চিহ্ন) থাকে। তবে অল্প মানের ক্যাপাসিটরের (যেমন: সিরামিক, মাইলার) কোন পজিটিভ-নেগেটিভ প্রান্ত থাকে না। ক্যাপাসিটরের গায়ে যে ভোল্ট লেখা থাকে (যেমন: 16V, 25V ইত্যাদি) তা হলো ওই ক্যাপাসিটরের সর্বোচ্চ সহনক্ষমতা। অর্থাৎ, কোন সার্কিটে ব্যবহৃত ক্যাপাসিটরের ভোল্ট ওই সার্কিটের পাওয়ার সাপ্লাইয়ের সমান বা বেশি থাকা প্রয়োজন। ডায়াগ্রামে ক্যাপাসিটরকে নিচের ছবির মত সাঙ্কেতিক চিহ্নের মাধ্যমে বোঝানো হয়।

ক্যাপাসিটর এর সাঙ্কেতিক চিহ্ন

এটি কনডেন্সার নামেও পরিচিত ।

ট্র্যানজিস্টর (Transistor): 

ইলেকট্রনিক্সের একটি অন্যতম পার্টস হলো ট্র্যানজিস্টর। এর তিনটি পা থাকে এবং প্রত্যেকটি পা-এর একটি করে নাম রয়েছে। নামগুলো হলো: ইমিটার (Emitter), কালেকটর (Collector) এবং বেস্ (Base)। সংক্ষেপে এদেরকে আদ্যাক্ষর অনুযায়ী বলা হয় E, C এবং B। ট্র্যানজিস্টর দেখতে সাধারণত নিচের ছবির মত । 

ট্র্যানজিস্টর (Transistor)
ট্র্যানজিস্টর

ট্র্যানজিস্টরগুলোর গায়ে একটি করে নম্বর লেখা থাকে (যেমন: C828, D400, BD135 ইত্যাদি) এবং এই নম্বরগুলোই হলো এদের পরিচয়। অর্থাৎ নম্বর উল্লেখ করলেই দোকানি আপনাকে আপনার কাঙ্ক্ষিত ট্র্যানজিস্টরটি দেবে। ডায়াগ্রামে এটি  নিচের ছবির মত সাঙ্কেতিক চিহ্নের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়।
ট্র্যানজিস্টর এর সাঙ্কেতিক চিহ্ন

চিহ্নটি লক্ষ করলে দেখতে পাবেন খাড়া একটি দাগের একপাশে একটি রেখা ও অন্য পাশে দু'টি রেখা রয়েছে। যেপাশে দু'টি রেখা বেরিয়েছে তার মধ্যে তীর-চিহ্নবিশিষ্ট রেখাটি নির্দেশ করে E এবং অপরটি C; আর যে রেখাটি  বাকি রইল সেটি হলো B । 

মূলত: দু'ধরনের ট্র্যানজিস্টর রয়েছে। 

যথাঃ

1. NPN (Negative Positive Negative) এবং 

2.PNP(Positive-Negative - Positive)।

জেনে অবাক হবেন যে আপনি ইতিমধ্যেই একটি সুন্দর মিউজিক্যাল সার্কিট তৈরি করার ক্ষমতা অর্জন করেছেন। ভাবছেন, কিভাবে? তাহলে আগে নিচের উদাহরণটুকু পড়ে নিয়ে আরেকটু পরিষ্কার ধারণা অর্জন করে নিন ।

উদাহরণ: এতক্ষণ আমরা তিন ধরনের পার্টস্ সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা লাভ করেছি। এখন আমরা এগুলোর ব্যবহারিক দিকটি দেখব। মনে করুন, আপনাকে নিচের ছবির মত একটি ডায়াগ্রাম দিয়ে বলা হলো সার্কিটটি তৈরি করতে । আপনি কী করবেন?

সার্কিট

প্রথমে আপনার কাজ হবে 390 ওহম ও 470 কিলো-ওহমের দু'টি রেজিস্টর এবং 10 মাইক্রো-ফ্যারাড মানের একটি ক্যাপাসিটর সংগ্রহ করা। এরপর ডায়াগ্রাম দেখে পার্টগুলো জোড়া দিলে আসল গঠন দেখতে হবে নিচের ছবির মত।

সার্কিট

মনে রাখবেন, ডায়াগ্রামে পার্টগুলো কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হবে শুধু তারই বর্ণনা থাকে। তা সে বাস্তবে যেমন অবস্থাতেই থাকুক না কেন। অর্থাৎ এলোমেলো ভাবে পার্টগুলো যেভাবেই রাখুন না কেন, ডায়াগ্রাম অনুযায়ী কানেকশন ঠিক রাখাই আসল কথা।

আবার আরেকটি উদাহরণ লক্ষ করুন। নিচের ছবির মত ডায়াগ্রাম হলে কী করবেন?

প্রথমে 22 কিলো-ওহম ও 100 ওহম মানের দু'টি রেজিস্টর, 47 মাইক্রো-ফ্যারাড মানের একটি ক্যাপাসিটর এবং একটি C828 নম্বরের ট্র্যানজিস্টর সংগ্রহ করবেন। আমরা আগেই জেনেছি, ট্র্যানজিস্টরের তিনটি পায়ের নাম E, C এবং B । এখন C828 নম্বরের ট্র্যানজিস্টরটির তিনটি পায়ের কোন্‌টি E, C এবং B তা নিচের ছবি লক্ষ করলে দেখতে পাবেন।

এবার ডায়াগ্রাম অনুযায়ী পার্টগুলোর কানেকশন দিলে তা বাস্তবে দেখতে হবে নিচেত ছবির  মত হবে।

পুরো ব্যাপারটি সময় নিয়ে ভালভাবে লক্ষ করুন। এই বিষয়গুলো যদি ভালমত বুঝে থাকেন তবে আপনি এখন ব্যবহারিক কাজে হাত দেয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রঃ

কাজ শুরু করার জন্য এখন আপনার প্রয়োজন হবে একটি 25 ওয়াটের মোটামুটি ভাল মানের (যেমন, চাইনিজ) সোল্ডারিং আয়রন (ঝালাইয়ের যন্ত্র) কিছু রাং (Solder) এবং মিউজিক্যাল সার্কিটের ডায়াগ্রামের পার্টগুলো। সোল্ডারিং আয়রন (যা সব সময় কাজে লাগবে) এবং অন্যান্য সবকিছুর মোট দাম পড়বে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। ইলেকট্রনিক পার্টস্ কিনতে পাওয়া যায় ঢাকার স্টেডিয়াম মার্কেট ও তৎসংলগ্ন মার্কেটগুলোতে (যেমন: সুইমিং পুল, আউটার স্টেডিয়াম ইত্যাদি)। তবে কেউ যদি কম দামে পার্টস্ কিনতে চান তাহলে পাটুয়াটুলী (পাইকারি) ইলেকট্রনিক্স মার্কেটটিই হবে সর্বোত্তম। আর ঢাকার বাইরের পাঠকদের প্রতি অনুরোধ রইল কষ্ট করে খুঁজে নিতে তাঁদের শহরের ইলেকট্রনিক পার্টসের মার্কেটগুলো।

ঝালাই (Soldering):

ইলেকট্রনিক পার্টস্ কিভাবে ঝালাই করতে হয় সে সম্বন্ধে বলছি। প্রথমে সোল্ডারিং আয়রনের প্লাগটি বাড়ির কারেন্ট সাপ্লাইয়ের সকেটে ঢুকিয়ে গরম হতে দিন। সোল্ডারিং আয়রনটি এমন কোনকিছুর উপর রাখুন যা সহজে দাহ্য নয় (যেমন: লোহা বা টিনের কোনকিছু)। কিছুক্ষণের মধ্যে সোল্ডারিং আয়রন পুরোপুরি গরম হলে কাজ শুরু করুন।



যে দু'টি পার্টসের পা ঝালাই করতে চান সে দু'টির পা এক জায়গায় রেখে ঠিক যে স্থানে ঝালাই করতে চান সেখানে সোল্ডারিং আয়রনের মাথাটি চেপে ধরুন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাং টুকুও সেখানে চেপে ধরুন। অর্থাৎ, চারটি জিনিস যেন একই সময়ে একই বিন্দুতে পরস্পরের সংস্পর্শে আসে। রাং গলে গিয়ে পার্টস দু’টির সংযোগ সম্পন্ন করামাত্র সোল্ডারিং আয়রনটি সরিয়ে ফেলুন।

সার্কিট ডায়াগ্রাম:

ডায়াগ্রামে চারকোনা সাঙ্কেতিক চিহ্নবিশিষ্ট পার্টটি নিশ্চয় চিনতে পারছেন না, যেটির নম্বর UM66। এই UM66 নম্বরের পার্টটি বাস্তবে দেখতে ট্র্যানজিস্টরের মত হলেও এটা আসলে একটি আই.সি. (I.C. - Integrated Circuit)। I.C. জিনিসটি কী তা পরবর্তীতে আপনাদের বিস্তারিত জানানো হবে। এখন শুধু জেনে রাখুন, I.C.-র পা-গুলো 1, 2, 3 ইত্যাদি নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয় এবং ট্র্যানজিস্টরের মত এটির গায়ে লেখা নম্বরই ( যেমন: UM66, MN4017, D4011 ইত্যাদি) এর পরিচয় বহন করে। আমাদের সার্কিটে পা-এর নম্বরসহ বাস্তব ছবিটি দেয়া হলো ব্যবহৃত I.C.টির।

I.C

পেন্সিল ব্যাটারি ডায়াগ্রামে আরেকটি নতুন জিনিস রয়েছে যা আশা করি সকলেই চিনতে পেরেছেন। সেটি হচ্ছে স্পিকার—যা দিয়ে শব্দ বের হবে। এটি 0.5 ওয়াটের ছোট স্পিকার। রেজিস্টর দু'টির কালার-কোড কেমন হবে তার বাস্তব চিত্রও দেয়া হলো।

রেজিস্টর

সার্কিটটি কিসের ওপর তৈরি করবেন এবার সেটা বলছি। পুরানো ফরমাইকা শীট অথবা মোটা কাগজে (কার্ডবোর্ড) প্রয়োজনমত দূরত্বে ছোট ছোট ছিদ্র করে পার্টগুলোর পা একপাশ থেকে ঢুকিয়ে অপর পাশে সরু ইনস্যুলেটেড তার দিয়ে ঝালাই করে কানেকশন দিন ডায়াগ্রাম অনুসারে। পার্টসের পা-গুলো প্রয়োজন মত বাঁকা করে বা কেটে ছোট করে নিয়ে খুব সাবধানে রাং দিয়ে ঝালাই করবেন। সোল্ডারিং আয়রন ১০ সেকেণ্ডের বেশি পার্টসের সংস্পর্শে রাখবেন না। কেননা অতিরিক্ত তাপে পার্টস্ নষ্ট হয়ে যায়। সব কানেকশন দেয়া সম্পন্ন হলে কমপক্ষে তিনবার ডায়াগ্রামের সাথে মিলিয়ে দেখে নিন যেন কোন ভুল না থাকে। এবার দু'টি পেন্সিল ব্যাটারি সংযোগ করুন সার্কিটের +3V এবং-3V পয়েন্টে। সুমধুর মিউজিকটি কি আপনার কানে পৌঁছেছে?

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url