ইঞ্জিন তৈলাক্তকরণ বা পিচ্ছিল করণ পদ্ধতি বা ইঞ্জিন লুব্রিকেটিং সিস্টেম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

ইঞ্জিন তৈলাক্তকরণ পদ্ধতি বলতে কী বুঝি?

ঘূর্ণনশীল ধাতব পদার্থ পরস্পরের ঘর্ষণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় ও অধিক তাপমাত্রার সৃষ্টি করে। ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশ ধাতব পদার্থে তৈরি। সুতরাং এ ক্ষেত্রে ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা হ্রাস বা দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে। আপত দৃষ্টিতে ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে সিলিন্ডার, লাইনার ও পিস্টন, বিয়ারিং, ক্র্যাংক শ্যাফট ইত্যাদি খুব মসৃণ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে ততটা মসৃণ নয়। এগুলোকে মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে বর্ধিত করে দেখলে দেখা যায় যে, এদের উপরিভাগ অসমান এবং অনেকটা খাঁচ কাটার মত।

ইঞ্জিন তৈলাক্তকরণ বা পিচ্ছিল করণ পদ্ধতি বা ইঞ্জিন লুব্রিকেটিং সিস্টেম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

 ঘর্ষনকালে অসমান উপরিভাগ পরস্পর পরস্পরকে বাঁধা দেয় এবং নানা প্রকার অসুবিধার সৃষ্টি করে। এ অবস্থা নিরসনকল্পে ঘর্ষনশীল ধাতব অংশের মধ্যবর্তী স্থানে তৈলাক্তকরণ বা পিচ্ছিলকারক হিসেবে আঠালো তেলের স্তর (Oil film) ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ থেকে আমরা ইঞ্জিন তৈলাক্তকরণের সংজ্ঞা দিতে পারি।

ইঞ্জিন তৈলাক্তকরণঃ ইঞ্জিনের পরস্পর সংস্পর্শে থাকা দু'টি চলমান বা ঘর্ষনরত ধাতব অংশের মধ্যবর্তী স্থানে আঠালো তেলের স্তর (Oil film) বজায় রেখে ক্ষয় বা উচ্চ তাপে জ্বলে যাওয়া থেকে রক্ষা করাকে ইঞ্জিন তৈলাক্তকরণ (Lubrication) বলা হয়। তৈলাক্তকরণে যে আঠালো তেল ব্যবহার করা হয় একে তৈলাক্তকারক (Lubricant) বলে। তৈলাক্তকারকের কাজ বা তৈলাক্তকরণের প্রয়োজনীয়তা ইঞ্জিন তৈলাক্তকরণ একটি অতিব গুরুত্বপুর্ণ প্ৰক্ৰিয়া। যথাযথ তৈলাক্তকরণের অভাবে একটি ইঞ্জিন অতি অল্প সময়ে ক্ষয় হয়ে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

আসুন আমরা ইঞ্জিন তৈলাক্তকরণের প্রয়োজনীয়তা বা তৈলাক্তকারকের কাজগুলো জেনে নেই। এ গুলো হচ্ছেঃ-

১। ঘর্ষন জনিত বাঁধা কমিয়ে শক্তির অপচয় রোধ করা।

২। চলনশীল অংশগুলোর ক্ষয়রোধ করা। 

৩। ইঞ্জিনের অভ্যন্তরীণ ঘর্ষনশীল অংশগুলো শীতল রাখা। লুব্রিকেশনের অভাবে ঘর্ষনশীল অংশগুলো জ্বলে যেতে পারে। বিশেষ করে পিষ্টন রিং সিলিন্ডারের গায়ে আটকে যেতে পারে।

৪। লুব্রিকেশনের অভাবে চলনশীল অংশগুলো যেমনঃ-সিলিন্ডার,লাইনার, রিং, বিয়ারিং, টেপেট, ভাল্‌ভ ইত্যাদি অংশ দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ঘর্ষনশীল অংশগুলোতে ঘর্ষনের ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধাতব কণা বের হয়। লুব্রিকেন্ট এ সমস্ত ধাতব কণাকে ধুয়ে পরিস্কার করে ক্র্যাংককেইজে নিয়ে যায়।

৫। পিষ্টন রিং ও সিলিন্ডার লাইনারের মধ্যবর্তী ক্লিয়ারেন্সকে আবদ্ধ বা সিল (Seal) করে রাখা। ফলে সংকোচন চেম্বারের গ্যাস ক্র্যাংক কেইজে যেতে পারে না।

৬। ঘূর্ণনশীল অংশকে তৈলাক্ত করে ইঞ্জিনের শব্দ কমানো।

ইঞ্জিনের নিম্নের অংশগুলোতে তৈলাক্তকরণ প্রয়োজন হয়। যথাঃ-

(ক) ক্র্যাংকশ্যাফ্ট ও ক্র্যাংক শ্যাফট মেইন বিয়ারিং।

(খ) কানেকটিং রড,বিগ এন্ড বিয়ারিং।

(গ) কানেকটিং রড, স্মল এন্ড বিয়ারিং / পিষ্টন পিন বিয়ারিং।

(ঘ) সিলিন্ডার লাইনার ও পিষ্টন রিং।

(ঙ) টাইমিং গিয়ার।

(চ) ক্যামশ্যাফট ও ক্যামশ্যাফট বিয়ারিং।

(ছ) ভাল্ভ মেকানিজম।

(জ) ভাল্ভ গাইড, ট্যাপেট ও ব্লকার আর্ম।

ইঞ্জিন তৈলাক্তকরণ পদ্ধতিসমূহঃ

তৈলাক্তকরণ পদ্ধতি সাধারণত পাঁচ প্রকার। যথাঃ-

(ক) পেট্রোল অয়েল সিষ্টেম (Petrol oil system)

(খ) ছিটানো পদ্ধতি (Splash system)

(গ) প্রেসার পদ্ধতি (Pressure system)

(ঘ) ছিটানো এবং প্রেসার পদ্ধতি বা যৌথ পদ্ধতি (Combination of splash and pressure system)

(ঙ) ড্রাই সাম্প পদ্ধতি (Dry sump system)

(১) ছিটানো পদ্ধতিঃ- ইঞ্জিনের গতিশীল অংশগুলোকে পিচ্ছিল করবার এটাই সহজ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে ইঞ্জিনের নিচের অংশে একটি তৈলাধার (অয়েল পাম্প) থাকে, যা পিচ্ছিলকারী তেল (মবিল) থাকে। ক্র্যাংকশ্যাটের প্রত্যেক ঘূর্ণনকালে ক্র্যাংকশ্যাফ্‌টের ক্র্যাংক পিন ও ক্র্যাংক আর্মের অংশ ক্র্যাংককেজের তেলে ডুবে যায়। ওপরে উঠার সময় এ অংশগুলো ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশে যেমনঃ-সিলিন্ডার ওয়াল, পিষ্টন রিং, মেইন বিয়ারিং, পিষ্টন পিন, বিগ ক্র বিয়ারিং, ভাল্ভ, টাইমিং গিয়ার ইত্যাদিতে তেল ছিটিয়ে দেয়।

এ তেল উক্ত অংশগুলিকে পিচ্ছিল বা তৈলাক্ত করে আবার ক্র্যাংক কেইজে ফিরে আসে। এ পদ্ধতি সাধারণত ছোট ধরণের এক সিলিন্ডার বিশিষ্ট ইঞ্জিনে ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে তৈলাধারে সর্বদা পরিমিত তেল থাকা অপরিহার্য।

(২) প্রেসার পদ্ধতিঃ- এ পদ্ধতিতে একটি গিয়ার পাম্প ক্র্যাংককেইজ হতে তেল গ্রহণ করে একে কিছুটা উচ্চ চাপে তা অয়েল গ্যালারীতে প্রেরণ করে। গিয়ার পাম্প ক্র্যাংকশ্যাফট দিয়ে চালিত হয়। গ্যালারী হতে চাপযুক্ত তেল ক্র্যাংকশ্যাফটের সরু ছিদ্র পথে প্রতিটি মেইন বিয়ারিং ও ক্যামশ্যাফ্ট বিয়ারিং -এ যায়। অতপর তৈলাক্তকারী তেল (মবিল) প্রতিটি মেইন বিয়ারিং হতে সংযোগকারী সরু ছিদ্রপথ দিয়া নিকটতম ক্র্যাংকপিনে পৌছে।

এ ভাবে মেইন বিয়ারিং ও কানেকটিং রড বিয়ারিং (বিগ এন্ড বিয়ারিং) তৈলাক্ত হয়। কোন কোন ইঞ্জিনে পিষ্টন পিনটি কানেকটিং রডের মাধ্যমে সরু ছিদ্রপথে চাপযুক্ত তেল পেয়ে তৈলাক্ত হয়। সাধারণত বিগ এন্ড বিয়ারিং, মেইন বিয়ারিং, ক্যাম শ্যাফ্ট বিয়ারিং, টেপেট, রকার আর্ম ও ভাল্‌ভকে এ পদ্ধতিতে তৈলাক্তকরণ করা হয়।

সিলিন্ডার ওয়াল, পিষ্টন, পিস্টন পিন ইত্যাদি কানেকটিং রড ও ক্র্যাংকশ্যাফট হতে ছিট্‌কে যাওয়া তেল (মবিল) দিয়ে তৈলাক্ত হয়।

(৩) ছিটানো এবং প্রেসার পদ্ধতি বা যৌথ পদ্ধতিঃ- আধুনিক বহু সিলিন্ডার বিশিষ্ট ইঞ্জিনে সাধারনত এ দুই পদ্ধতির সংমিশ্রণে তৈলাক্তকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এ পদ্ধতিতে ইঞ্জিনের কিছু গতিশীল অংশ ছিটানো পদ্ধতিতে এবং বাকী গতিশীল অংশগুলো প্রেসার পদ্ধতিতে তৈলাক্ত হয়। এ পদ্ধতিতে তেল পাম্পের সাহায্যে ষ্টেইনারের মাধ্যমে অয়েল লাইনে প্রবেশ করে। অয়েল লাইন হতে তেল কানেকটিং, রড, বিয়ারিং, ক্র্যাংকশ্যাফট ও ক্যাম শ্যাফটের নিচে অবস্থিত তেলাধারে স্থানান্তরিত হয়।

কানেকটিং রড, বিয়ারিং ক্যাপ ক্র্যাংকশ্যাফট প্রত্যেক আবর্তনে তেলাধারে প্রবেশ করিতে সাহায্য করে। এর ডুবন্ত অংশ তেলাধার হতে তেল তুলে ইঞ্জিনের ওপরের যন্ত্রাংশগুলোতে সরবরাহ করে। এ ছিটকে ওঠা তেল আবার ভাল্ভ, পিস্টন পিন, সিলিন্ডার ওয়াল, পিস্টন রিং এবং ক্র্যাংক শ্যাফ্ট প্রভৃতিকে তৈলাক্তকরণের মাধ্যমে পিচ্ছিল করে। এ পদ্ধতিতে ক্র্যাংককেইজে প্রয়োজনীয় তেল জমা রাখা হয়।

ক্র্যাংককেইজ হতে একটি ষ্টেইনারের মাধ্যমে তেলকে ছেঁকে ময়লামুক্ত করে পাম্পে নেয়া হয়। সাধারনত ক্র্যাককেইজ বা ষ্টেইনারে চুম্বক ব্যবহার করা হয়। চুম্বক ধাতব কণাগুলোকে ধরে রাখে। পাম্প হতে বিভিন্ন অংশে তেল সরবরাহের পূর্বে একে ফিল্টারের সাহায্যে পরিস্রাবণ করা হয়। পরিস্রত তেলকে বিভিন্ন অংশে পৌছানোর মাধ্যমে তৈলাক্ত করা হয়।

তৈলাক্তকারকের (Lubricant) শ্রেণিবিভাগঃ

বিভিন্ন ধরনের তৈলাক্তকারক ইঞ্জিন ও মেশিনে ব্যবহার হয়ে থাকে। যথাঃ-

১। গ্যাসীয় পদার্থঃ- বাতাস, হিলিয়াম, নাইট্রোজেন ইত্যাদি

২। তরল জাতীয় পদার্থঃ- ধাতব জাতীয় তেল, পশু ও শাক সব্জীর তেল ইত্যাদি।

৩। আধা শক্ত পদার্থঃ- গ্রীজ, সোপ ইত্যাদি।

৪। শক্ত পদার্থঃ- গ্রাফাইট।

ইঞ্জিনের মূল কর্মপদ্ধতি বা ইঞ্জিনের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

তৈলাক্তকারকের ধর্মাবলীঃ

১। তৈলাক্তকারকের উপযুক্ত সান্দ্রতা (Viscosity) থাকবে । তাপমাত্রার পরিবর্তনে সান্দ্রতার পরিবর্তন হবে না।

২। প্রজ্জ্বলন ক্ষমতা নেই।

৩। বিষাক্ততা ও বিস্ফোরণ ক্ষমতা নেই।

৪। বায়ু, তেল বা পানির সাথে মেশে না, ফেনা তৈরি করে না এবং উদ্বায়ী নহে।

৫। পরিস্কার করার ক্ষমতা রয়েছে এবং ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশের কোন ক্ষতি করে না। তৈলাক্তকারক তেল অত্যধিক পাতলা হলে এতে প্রয়োজন অনুপাতে তেলের মান উন্নয়নকারী উপাদানসমূহ মেশাতে হয়। এতে তেলের গুণগতমান বজায় থাকে।

ডিজেল ইঞ্জিন ও ডিজেল ইঞ্জিনের প্রধান কার্যকরী অংশসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

উপরোক্ত আলোচনা হতে আমরা তৈলাক্তকরণ তেলের প্রবাহের ক্ষেত্রকে চারটি প্রধান স্তরে ভাগ

করতে পারি। যথাঃ-

১। পিস্টন ও সিলিন্ডারের প্রবাহ।

২। ক্র্যাংক শ্যাফট ও কানেকটিং রড বিয়ারিং এ প্রবাহ।

৩। গিয়ার ও অন্যান্য সাহায্যকারী ঘূর্ণায়ন যন্ত্রাংশে তেলের প্রবাহ।

৪। রকার আর্ম, ভাল্ভ এবং ভাল্‌ভগুলোতে তেলের প্রবাহ।

পেট্রোল ইঞ্জিনের প্রধান কার্যকরী অংশসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

সারমর্মঃ সাধারণত ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশ ধাতব পদার্থে তৈরি। ঘর্ষণজনিত কারণে এ অংশগুলো যাথে উচ্চ তাপে জ্বলে না যায় বা ক্ষয় হয়ে না যায় এজন্য ইঞ্জিন তৈলাক্তকরণ করা হয়ে থাকে। পাঁচ ধরনের তৈলাক্তকরণ পদ্ধতি থাকলেও আধুনিক ইঞ্জিনে প্রধানত ছিটানো পদ্ধতি, প্রেসার পদ্ধতি এবং ছিটানো ও প্রেসার পদ্ধতি বা যৌথ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

ইঞ্জিন শীতলীকরণ পদ্ধতি বা ইঞ্জিন কুলিং সিস্টেম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url